৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

চোখ ভিজছে, মন পুড়ছে

spot_img

মনটা পুড়ে গেছে। পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি। সারারাত ঘুম হয়নি। ফুটফুটে বাচ্চাদের জন্য ভেতরে হাহাকার। ওরা ঝলসে গেছে দেড় হাজার ডিগ্রি তাপে। পোড়া শরীর নিয়ে ছুটছে! কি ভয়াবহ দৃশ্য! প্রথমে ভেবেছিলাম গাজা। পরে দেখি মাইলস্টোন। ভিডিও দেখে অসুস্থবোধ করছি। শুধু চোখ ভিজে যাচ্ছে। কোনো দৃশ্যই সহ্য করতে পারছি না। পড়তেও পারছি না।

চারপাশে শুধু দেখতে পাচ্ছি, শত শত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ওঁৎ পেতে আছে। ইচ্ছে হলেই বাঁশিতে সুর তুলছে। আমাদের সবটুকু স্বপ্ন-মায়ায় গড়া সন্তানদের নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। বুকের ধন হারানো পরিবারগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা শুধুই কাঁদছি, বুকে পাথর বাঁধছি!

গোটা দেশে রাজনীতির রাক্ষসরা কিলবিল করছে। এরা ফুল-পাখিও গিলে ফেলে। শিশুদের বাসযোগ্য পৃথিবী এরা বোঝে না। ওদের স্বপ্ন বোঝে না। শিশুশিক্ষা বোঝে না। গবেষণা বোঝে না। বোঝে শুধু টাকা, ক্ষমতা, পেশিশক্তি। দানবই তো এরা।

আশি-নব্বই দশকে নকলের উৎসব করে শিশু-তরুণদের মনস্তত্ত্ব ক্ষত করা হয়েছে। নব্বইয়ের পর পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক মাস্তানি, ধর্ষণ, খুনোখুনিময় জিঘাংসার বৈরী পরিবেশে বড় হতে হয়েছে আমাদের কোমলমতি শিশুদের। একুশ শতকে এসেও শিশুর জন্য বাসযোগ্য, শিশুবান্ধব দেশ গড়তে পারিনি।

আমাদের সন্তানরা একপাল মুর্খ, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, প্রতিহিংসাপরায়ণ, দানব রাজনীতিকের হাতে দেশ পরিচালনা হতে দেখেছে, দেখছে। যেখানে শুধুই ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, ক্ষমতার অপব্যহারের উৎসব। রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়া পাড়ার মাস্তান, ছিনতাইকারী, বখাটের হাতে প্রিয় ভিসি, প্রিন্সিপাল, শিক্ষক, সিনিয়র সিটিজেনদের অবিরাম অপদস্থ হতে দেখে দেখে বড় হয়েছে আমাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানরা।

শুধু ওরা চেয়ে চেয়ে দেখেছে এতকাল। এত বৈরীতার মধ্যেও লড়াই করে গেছে। ভালো ফলাফল করেও সুযোগ না পেয়ে চলে গেছে বিদেশে। অনেকে নাসায় গেছে। কেউ গুগল, মাইক্রোসফট সামলাচ্ছে। আমরা সেরা মেধাবী বাচ্চাদের দেশে রাখতে পারিনি। বেকারত্ব, মানবতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কাছে তারা বার বার মার খেয়েছে।

ভেতর থেকে ভেঙে পড়া, চোখধাঁধানো রাজনৈতিক উন্নয়নের তাণ্ডব থেকে শেষ অবধি উঠে দাঁড়াল আমাদের কিছু ডানপিটে সন্তান। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাষ্ট্র মেরামতের সিস্টেম দেখিয়ে চমকে দিল। আইন যে সবার জন্য সমান সেটার বাস্তব প্রয়োগ দেখাল। অথচ, ফুলের মতো সুন্দর শিশুদের প্রতিপক্ষ ভেবে তাদের নির্দয়ভাবে পেটানো হলো।

মেধাবী, শান্ত শিশুদের জেদ অনেক ভয়ঙ্কর। তাদের জেদ বাড়িয়ে দেওয়ার করুণ পরিণতি এসে ঠেকল জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। সড়ক নিরাপদ করতে এসে যেসব শিশু রক্তাক্ত হয়েছিল, তারাই জুলাইয়ে শপথ নিয়েছিল এবার রক্ত নয়, প্রাণবাজি। প্রাণের বিনিময়ে রাজনীতি মেরামত। বুড়ো-ভাম রাজনীতিকরা শিশুদের ট্যাগ দিল। আরেক দল ধন্যধন্য বলে আবেগে ভাসল।

সেই জুলাইয়েই শিশুদের কলকাকলি মুখরিত মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে আছড়ে পড়ল শাসকদের লোভের অগ্নিবোমা ‘ভাঙারি’ যুদ্ধবিমান। আগুনের তাপে, ভয়ঙ্কর শব্দের তাণ্ডবে প্রাণ হারাল কত ফুলপাখি। দগ্ধ ফুলেরা কাতরাচ্ছে হাসপাতালে হাসপাতলে, মৃত্যু যেন হাতছানি দিচ্ছে।

মাঠে গিয়ে রিপোর্টারা কাঁদছেন, ক্যামেরাম্যানরা আবেগে ভাসছেন। খবর লিখতে গিয়ে সংবাদকর্মীরা কি বোর্ড ভিজিয়ে ফেলছেন। পর্দায় খবর পড়তে আবেগে জমে যাচ্ছেন প্রেজেন্টাররা। এমন কান্নাভেজা দুপুর, রাত, সকাল যেন কখনও না আসে। আমরা সব সহ্য করতে পারি, দেড় হাজার ডিগ্রি তাপে আমাদের প্রাণপ্রিয়দের কোমল শরীর ঝলসে যাওয়া দেখতে পারি না! শিশুর জন্য বাসযোগ্য হোক পৃথিবী, বাংলাদেশ।

লেখক: মতিউল ইসলাম নিয়ন

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ