৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

পাকিস্তান তুরস্ক ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সম্পর্ক

spot_img
ড. এহতেশামুল হক:
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান, তুরস্ক ও চীনের ঘনিষ্ঠতা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পাকিস্তান এবং ১৯৭১ প্রসঙ্গ আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রথমে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব ও পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়ের সফরের সময় বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একাত্তর ইস্যুকে সামনে আনা হয়েছে, যা ছিল অতিথিদের জন্য বিব্রতকর। ফলে বাংলাদেশ যদি ৭১ ইস্যুতে ছাড় না দেয়, তবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন থেকেই যাবে।

ভারত এবং পাকিস্তানকে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে প্রায় সমান। কিন্তু সে হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের যে সামরিক প্রভাব থাকার কথা, ভারতের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তা তেমন হয়ে ওঠেনি। বারবার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার ফলে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক উত্তরণ হোঁচট খেয়েছে। ফলে তারা রাজনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হয়েছে। আঞ্চলিক জোট সার্কে ভারতের অসহযোগিতার কারণে পাকিস্তান এ অঞ্চলের রাজনীতিতে ব্যাকফুটে থেকে গেছে। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে ভারত বাংলাদেশে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল নামেমাত্র। চব্বিশের বিপ্লবের পর এ অবস্থার রাতারাতি উন্নতি ঘটে। স্বাধীনতার পর প্রথম কোনো পাকিস্তানি বাণিজ্যিক জাহাজের সরাসরি বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে নোঙর করা দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা করেছে। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান উভয়ের একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তৈরির পাশাপাশি উভয়ের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে।

দীর্ঘ ১৩ বছর পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর করলেন গত আগস্টে। বাংলাদেশ সফরে এসে তিনি সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

কাকতালীয় হলেও ইসহাক দারের সফর এমন একসময়ে ঘটছে, যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে অবস্থান করছেন। এছাড়া সম্প্রতি জামায়াত নেতাদের চীন সফর এবং নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতাদের চীন সফরের আমন্ত্রণ আঞ্চলিক রাজনীতিতে নানা কৌতূহলের পাশাপাশি নিশ্চিতভাবেই ভারতীয় হেজেমনিতে নতুন ঝড়ের সৃষ্টি করেছে। কারণ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দেশটি নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামরিক বলয়ে থাকতে আগ্রহী।

পাকিস্তানের পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বের আরেক উদীয়মান দেশ তুরস্কের বাণিজ্যমন্ত্রীর গত ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফর বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের বিদ্যমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। ২০১৮ সালে তুরস্কের ‘পুনরায় এশিয়া’ (এশিয়া এনিউ) নীতির আলোকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে তাদের প্রধান সহযোগী হিসেবে ঘোষণার পর থেকে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বেড়েই চলেছে। আর চীনের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান-তুরস্ক-চীনের একটি বাণিজ্যিক বলয় তৈরি হতে পারে, যদিও আনুষ্ঠানিক এমন কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশের বিশাল বাজারকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো দেশই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে।

পাকিস্তান ঠিক সেই সুযোগকেই কাজে লাগাতে সচেষ্ট। নিজ স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে বাংলাদেশও এখান থেকে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ভারত নিঃসন্দেহে এ বলয়কে ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। কারণ বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি পাকিস্তান চাইবে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে বাংলাদেশে তার প্রভাব বাড়াতে, যার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। আর তুরস্ক তো বিগত সরকারের আমল থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক ধীরে ধীরে বাড়িয়ে চলেছে। সামরিক খাতে বৈদেশিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশে নতুন অস্ত্রের বাজারের সম্ভাবনা। আঞ্চলিক কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক তো আছেই।

পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এছাড়া বাংলাদেশের বেশির ভাগ অস্ত্র আমদানি চীন থেকে হওয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির একধরনের স্থিতিশীল সামরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি হলে তা তুরস্ক এবং চীন উভয় দেশকেই সুবিধা দেবে। তবে বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে তার ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ এবং এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ বাস্তবায়নে আঞ্চলিক উদীয়মান অর্থনীতির দেশ, পারমাণবিক শক্তিধর এবং মুসলিম দেশগুলোর জোটে (ওআইসি) প্রভাবশালী সদস্য পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা জরুরি।

বর্তমান বিশ্বকে তাক লাগানো তুরস্কের আধুনিক সমরাস্ত্রের সংযোজন বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতাকে কয়েক ধাপ বাড়াতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে তুরস্ক থেকে যেসব অস্ত্র কিনেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তুরস্ক একমাত্র ন্যাটোভুক্ত মুসলিম দেশ, যার রয়েছে পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক বিশাল সেনাবাহিনী। সুতরাং প্রতিবেশী ভারত কখনো চাইবে না তার বলয়ে পাকিস্তানের বন্ধু তুরস্কের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হোক। কারণ দিনশেষে এসবই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তানকেই সুবিধা দেবে বেশি। তবে বাংলাদেশ সমরাস্ত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক নীতি অবলম্বন করছে। বাংলাদেশের উচিত হবে তার কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে যথাসম্ভব আঞ্চলিক এবং বহিঃশক্তিগুলোর সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে নিজের বাণিজ্যিক এবং সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর প্রশ্নে কোনো ছাড় না দেওয়া।

লেখক : সিনিয়র লেকচারার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ