জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
মদিনার বাতাসে তখন শোক আর শঙ্কার গুমোট। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। সাহাবিদের চোখে অশ্রু, হৃদয়ে অস্থিরতা। হঠাৎ একদিন—সফর মাসের শেষ বুধবার—অলৌকিকভাবে তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। শয্যা থেকে উঠে বসলেন, গোসল করলেন, তারপর ক্লান্ত শরীর নিয়ে প্রবেশ করলেন মসজিদে নববীতে। সাহাবিদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে তিনি ইমামতি করলেন, কণ্ঠে ভেসে উঠল কুরআনের তিলাওয়াত। মদিনার আকাশ-বাতাসে সেই শব্দ ছড়িয়ে দিল প্রশান্তি। অশ্রুভেজা আনন্দে ভরে উঠল সাহাবিদের মুখ, আল্লাহর দরবারে তারা শুকরিয়া আদায় করলেন, দান-সাদকার হাত বাড়ালেন দরিদ্রদের দিকে।
এ ঘটনাই পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজে “আখেরি চাহার সোম্বা”—অর্থাৎ সফর মাসের শেষ বুধবার—নামে পরিচিত হয়। ফার্সি শব্দ “আখেরি” মানে শেষ, আর “চাহার সোম্বা” মানে বুধবার। সাহাবিদের সেই আনন্দঘন মুহূর্তের স্মৃতি আজও ইতিহাসের পাতায়, মানুষের হৃদয়ে এক অমলিন রেখার মতো রয়ে গেছে।
সহিহ হাদিসে নবীজীর অসুস্থতার বিবরণ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। আয়েশা (রা.) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অসুস্থতা শুরু হয়েছিল যেদিন তিনি উহুদের শহীদদের কবর জিয়ারত করে ফিরেছিলেন।” (সহিহ বুখারি ৪৪৫১; সহিহ মুসলিম ১৬২৮)
অসুস্থতার শেষ সময়ে তাঁকে সাত মশক পানি ঢেলে গোসল করানো হয়, তারপর তিনি সাময়িক স্বস্তি অনুভব করেন এবং সাহাবিদের সঙ্গে নামাজে দাঁড়ান। (সহিহ বুখারি ৪৪৪২)
তবে নবীজি (সা.) সতর্ক করে বলেছেন, “যে আমাদের দ্বীনে এমন কিছু সংযোজন করবে, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।” (সহিহ মুসলিম ১৭১৮; সহিহ বুখারি ২৬৯৭)
এই বাণী স্পষ্ট করে দেয়—নির্দিষ্ট দিনকে আলাদা করে ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করার আগে সহিহ দলিল থাকা অপরিহার্য।
সিরাতকার ইবনে হিশাম ও ইবনে কাসিরও নবীজীর অসুস্থতার সময়কাল বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা উল্লেখ করেন, অসুস্থতা শুরু হয়েছিল সফরের শেষ দিকে এবং মৃত্যুবরণ হয়েছিল রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখে। কিন্তু তারা কোথাও “শেষ বুধবার”কে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেননি। ফলে হাদিস ও সিরাতের আলোকে দিনটি নির্দিষ্ট ইবাদতের দিন নয়; বরং সাহাবিদের এক আবেগঘন মুহূর্তের স্মৃতিই এ দিনের ভিত্তি।
সময়ের সাথে সাথে স্মৃতি রূপ নিয়েছে ঐতিহ্যে, ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে সংস্কৃতি। বাংলাদেশ ও উপমহাদেশে আজও আখেরি চাহার সোম্বা পালিত হয় সামাজিক ও আধ্যাত্মিক আয়োজনে। মানুষ গোসল করে নফল নামাজ পড়ে, কুরআনখানি, মিলাদ-মাহফিল আয়োজন করে, দরিদ্রদের আহার করায়, দান-সাদকা করে। দরবার-খানকা ও মসজিদে জমে ওঠে বিশেষ দোয়া-মোনাজাতের মাহফিল। সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে কৃতজ্ঞতার আবহ। এমনকি রাষ্ট্রীয় ছুটির তালিকায়ও দিনটি ঐচ্ছিক ছুটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কেউ কেউ একে বিদআত মনে করেন, কারণ শরীয়তে দলিল ছাড়া দিনটিকে আলাদা করে ইবাদতের সময় বানানো যায় না। তবে অন্য দৃষ্টিতে, এ দিনটিকে যদি নিছক স্মরণ ও কৃতজ্ঞতার উপলক্ষ হিসেবে ধরা হয়—যেখানে দান-সাদকা, নফল ইবাদত ও মানবসেবার চর্চা হয়—তাহলে তা ইসলামের মূল চেতনার সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আখেরি চাহার সোম্বা তাই শুধু একটি দিন নয়, বরং স্মৃতির একটি প্রতীক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় নবীজীর অন্তিম জীবনের আবেগঘন অধ্যায়, সাহাবিদের অশ্রুসিক্ত আনন্দ, আর কৃতজ্ঞতার সুর। হয়তো দলিলের কড়াকড়ি চোখে এটি নিছক ঐতিহ্য, কিন্তু আবেগের চোখে এটি প্রিয় নবীজীর স্মৃতিকে ঘিরে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার অশ্রুজল।
শেষ পর্যন্ত এ দিনটি শেখায়—ইতিহাস ও আবেগ, শরীয়ত ও ঐতিহ্য—সব মিলেই ইসলামি সংস্কৃতির রঙিন ক্যানভাস তৈরি হয়। নবীজীর স্মৃতির সঙ্গে যে কোনো উপলক্ষই আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। আখেরি চাহার সোম্বা সেই অনুপ্রেরণারই আরেকটি নাম—যেখানে কৃতজ্ঞতার আলোয় ভেসে ওঠে শেষ বুধবারের স্মৃতি।