
নির্বাচন কমিশন যতই জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করছে, বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতির বিতর্ক ততই জোরালো হয়ে উঠছে। নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি বনাম পুরনো পদ্ধতির এই রাজনৈতিক বিতর্ক ক্রমেই সংঘাত সহিংসতার পথে ধাবিত হচ্ছে।
বিএনপি কিছুতেই পিআর পদ্ধতির নির্বাচন মানতে চাচ্ছে না। অপরদিকে বিএনপির প্রতিপক্ষ জামায়াত-এনসিপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতি ছাড়া কিছুতেই নির্বাচন হতে দিতে চাচ্ছে না।
নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সৃষ্ট এই বিতর্ক-বিবাদের কারণে দেশে আদতে নির্বাচনই হবে কিনা, সেই সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে আজ পর্যন্ত দেশটি ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট,এফপিটিপি বা ‘প্রথম বিজয়ী-প্রথম নির্বাচিত’ ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ বিতর্ক ও বিভাজন তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যেখানে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব তথা প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনেটশন বা পিআর ভিত্তিক নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে, সেখানে বিএনপি এই পদ্ধতির প্রবল বিরোধিতা করছে।
বাংলাদেশের মতো বহুমাত্রিক রাজনৈতিক সমাজে পিআর পদ্ধতি চালু হলে কী কী সুফল বয়ে আনতে পারে, সেটাই সহজভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই লেখায়।
বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় ৩টি সীমাবদ্ধতা নিচে উল্লেখ করা হয়েছে।
এক. গণতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে
বর্তমানে বাংলাদেশে সংসদীয় আসন ৩০০টি, যার প্রতিটিতে একজন প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পেলেই বিজয়ী হন। এই পদ্ধতিতে ৪০শতাংশ ভোট পেলেও একজন প্রার্থী জয়ী হতে পারেন, অর্থাৎ বাকি ৬০ শতাংশ ভোট অপ্রতিফলিত থেকে যায়।
এরফলে একটি দল দেশের মোট ভোটের মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ পেয়েও সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে ক্ষমতায় যেতে পারে। এরফলে গণতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ক্রমেই নির্বাচিত স্বৈরাচার হতে হতে একপর্যায়ে ফ্যা.সিস্ট হয়ে ওঠে ।
দুই. ছোট দল ও বিকল্প মতের দমন
বর্তমান ব্যবস্থায় ছোট দল বা আঞ্চলিক দলগুলো সংসদে প্রবেশের সুযোগ পায় না। তাদের ভোট নষ্ট হয়, ফলে তারা জাতীয় আলোচনায় গুরুত্ব হারায়। ফলে মতাদর্শগত বৈচিত্র্য সংকুচিত হয়।
তিন. রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রভাব খাটানো
একক আসনে একমাত্র বিজয়ের লড়াই হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনের নামে দলীয় দখলদারি, ব্যালট ছিনতাই, প্রশাসনিক পক্ষপাত ইত্যাদি বেড়ে যায়।
বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির এইসব সীমাবদ্ধতা কাটাতে পিআর পদ্ধতির ৩টি সুবিধা নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. মোট প্রাপ্ত ভোটের মূল্যায়ন হয়
পিআর বা অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়। অর্থাৎ যদি কোনো দল মোট ভোটের ২৫ শতাংশ পায়, তবে তার সংসদে আসনও হবে ২৫ শতাংশ ।
২. কম ভোট পেলেও বেশি আসন পাওয়া যায়
১০ কোটি ভোটারের মধ্যে কোন দল যদি মাত্র আড়াই কোটি ভোট পায়, তাহলে সেই দল সংসদের ৩শ আসনের মধ্যে ৭৫টি আসন পাবে।
৩. ভোটাররা শুধু দলকে ভোট দেয়
সাধারণত এটি জাতীয় দলীয় তালিকা ভিত্তিক হয়। এছাড়ায় আরেকটি ভিন্ন ধরণ আছে, যেখানে দল তার তালিকা তৈরি করে, ভোটাররা শুধু দলকে ভোট দেয়। ভোটাররা তালিকাভুক্ত প্রার্থীকে সরাসরিও ভোট দিতে পারেন। আংশিক আসন সরাসরি, বাকি অনুপাতিকভাবেও নির্ধারিত হয়।
যে ১০ কারণে বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতির কোন বিকল্প নেই, এখন সেই সব কারণগুলো এখানে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে-
প্রথমত: রাজনৈতিক বৈচিত্র্য ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়
বাংলাদেশে যেমন জাতীয়তাবাদী,ধর্মনিরপেকক্ষ দল; তেমনি রয়েছে ইসলামপন্থী দল, বামপন্থী জোট, আঞ্চলিক দল, আদিবাসী নেতৃত্ব এবং নারী অধিকার ভিত্তিক সংগঠন। পুরানা পদ্ধতির নির্বাচনে এসব দলের মধ্যে অধিকাংশ দলের প্রতিনিধিত্ব প্রায় অনুপস্থিত থাকে। কিন্তু পিআর ব্যবস্থায় তাদের সকলের প্রতিনিধিত্ব বাস্তবে সম্ভব হবে।
দ্বিতীয়ত : ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে
পিআর পদ্ধতিতে প্রত্যেক ভোটের মূল্য রয়েছে। যে দলের যত ভোট, তার তত আসন।এতে জনগণের আস্থা ও ভোটদানে আগ্রহ বাড়বে। ভোট নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।
তৃতীয়ত : সহিংসতা ও অনিয়ম হ্রাস পায়
পিআর পদ্ধতিতে ভোটারদের মনোনিবেশ থাকে দলভিত্তিক জাতীয় তালিকায়র দিকে। আঞ্চলিক প্রভাব খাটানো,সন্ত্রাস-সহিংসতা সৃষ্টি কিংবা একক ব্যক্তির দখলদারি বা কেন্দ্র দখলের কোন প্রবণতা থাকে না। এতে ভোটগ্রহণ হয় নিয়মতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ।
চতুর্থত : গণতন্ত্রে নারীর অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি পায়
পুরানা নির্বাচন পদ্ধতিতে বাংলাদেশের নারীরা দলীয় রাজনীতিতে এগোতে হিমশিম খায়। পিআর পদ্ধতিতে দলীয় তালিকায় নারী কোটা নিশ্চিত করা সহজ হয়। নেপাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, রুয়ান্ডার মতো দেশে পিআর ব্যবস্থায় নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
পঞ্চমত : সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুযোগ বাড়ে
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, দলিত, প্রতিবন্ধী প্রভৃতি গোষ্ঠী দলের মাধ্যমে সংসদে প্রতিনিধিত্ব পেতে পারে। পুরানা পদ্ধতিতে এটা অতীতেও যেমন সম্ভব হয়নি,ভবিষ্যতেও তেমনি হবে না। পিআর পদ্ধতি সমাজে সামাজিক সম্প্রীতি ও অংশগ্রহণমূলক নীতি গঠনের পথ তৈরি করে।
ষষ্টত : রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ে
পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে জনগণের কাছে তাদের কার্যকর পলিসি উপস্থাপন করতে হয়। কেবল জনপ্রিয়তা দিয়ে নয়, নীতিনির্ধারণে দক্ষতা দিয়েই ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে হয়। পুরানা পত্ধতিতে এসবের প্রয়োজন পড়ে না। আগের পদ্ধতি নীতির পরাজয় ঘটে আর হুজুগে জনতার হুজুগের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের জয় হয়।
সপ্তমত: জোট ও সহযোগিতামূলক রাজনীতির উত্থান ঘটে
পিআর ব্যবস্থায় একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় জোট সরকার গঠন বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। এতে সরকার হয় সহযোগিতাপূর্ণ, সংলাপভিত্তিক ও ভারসাম্যপূর্ণ।
অষ্টমত : আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা প্রসংশনীয়
জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড প্রভৃতি দেশে পিআর ব্যবস্থায় নির্বাচনী বৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সংবিধান সম্মত সরকার গঠন এবং সুশাসনের মান তুলনামূলকভাবে ভালো।
নবমত : দক্ষিণ এশিয়ায় পিআর পদ্ধতির সুফল
আমাদের পার্শ্ববর্তী নেপালে পিআর ব্যবস্থা চালু হওয়ায় মাওবাদী ও দলিত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়েছে। এরফলে সেখানে দীর্ঘদিনের সংকটের আবসান হয়েছে।
ভারতে রাজ্যসভায় আংশিকভাবে অনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতির ভোট প্রয়োগ হয়। পাকিস্তানেও সংখ্যালঘু ও নারী আসনের ক্ষেত্রে পিআর ভিত্তিক মনোনয়ন ব্যবস্থাপনা বহাল রয়েছে এবং এই পদ্ধতিতে সেখানে বেশ সুফল পাচ্ছে।
দশমত: সময়ের দাবি
রক্তঝরা চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো শহীদের রক্তেভেজা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতির নির্বাচন এখন সময়ের দাবি। এটি কেবল রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নয়, গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র, নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিকেও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে। সেজন্য এর কোন বিকল্পভাবা শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।
নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনে সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্খা এবং শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এটা খুবই সুপল দিবে।বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে এই সময়ে তাই পিআর পদ্ধতির কোন বিকল্প নেই ।
……………………………………
এফ শাহজাহান
ক্রাইসিস অ্যানালাইসিস
২৬ জুলাই ২০২৫
…………………………………….