৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতপন্থী ও ভারত বিরোধীতার নয়া মেরুকরণ

spot_img

‘‘শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করেছি”- বাংলাদেশের তৎকালীন ফ্যা.সি.স্ট হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের এই বক্তব্য দেয়ার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছিল, তার করুন পরিনতি আমরা দেখেতে পেয়েছিলাম রক্তঝরা জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনার পালানোর দৃশ্যপটে।

বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই ভারতের দালাল ও পাকিস্তানের দালাল নামের ‘রাজনৈতিক গালি’ প্রচলিত ছিল। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জাতির মনে সন্দেহ ছিলো যে, যাদেরকে পাকিস্তান ও ভারতের দালাল বলা হয়, তারা আদতেই ভারত-পাকিস্তানের দালাল কিনা।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এবার বাস্তবে দেখা গেলো, এতোদিন যাদেরকে পাকিস্তানের দালাল বলে গালি দেওয়া হতো, তারা ফাঁসিতে ঝুলেছে কিন্তু কেউ পাকিস্তানে পালায়নি। অপরদিকে যাদেরকে ভারতের দালাল বলা হতো; তারা সবাই ভারতে পালিয়েছেন।

এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে পাকিস্তানের দালাল বলে কেউ না থাকলেও ভারতের দালালেরা ঠিকই আছে। সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যারাই রুখে দাঁড়াতো,এতাদিন তাদেরকেই পাকিস্তানের দালাল তকমা লাগিয়ে দমিয়ে রাখা হতো।

এখন সময় পাল্টে গেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম শত্রু প্রতিবেশি ভারতকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দ্বিমূখী মেরুকরণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখন ভারতপন্থী এবং ভারতবিরোধী শিবিরে বিভিক্ত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি।

২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের নামে প্রহসনের পর বাংলাদেশে মাঠের রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতার বিষয়টি দৃশ্যমান হওয়া শুরু করেছিল। ঢাকায় ছোটখাট দল বা সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তখন থেকেই প্রকাশ্যে ভারত বিরোধী ব্যানার, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করতে দেখা যাচ্ছিল।

ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে যাওয়ায় বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট প্রকট আকার ধারণ করতে শুরু করে।

এমন এক সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে দ্বিধাবিভক্ত করে জাতীয় ঐক্য ব্নিষ্ট করার মাধ্যমে জাতীয় শক্তিকে দুর্বল করে রাখা হতো। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পর রাজনীতির সেই ‘সিনেম্যাটিক মিথ’ মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে।

জনতার সামনে এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে, এতোদিন ‘পাকিস্তানপন্থী’ তকমা লাগিয়ে যাদের বিরুদ্ধে চরম দমন নির্যাতন চালানো হয়েছিল; তাদের কেউ পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়নি। পাকিস্তানও তাদেরকে কখনো আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়নি। অপর দিকে যারা বাংলাদেশকে ভারতের করদরাজ্য বানানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন ,তারা দেশপ্রেমিক জনতার নবজাগরণে ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং ভারত তাদেরকে এখনো আশ্রয়-প্রশ্রয় সবই দিচ্ছে।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো একপক্ষ মনে করছে, ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকা সম্ভব নয়।

বিপরীত মেরুর আরেক পক্ষ মনে করছে, ভারতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া ছাড়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

চব্বিশের রক্তঝরা বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যা.সি.স্ট হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের এক নতুন টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।

২০২৪ সালের আগস্টের মাঝামাঝি ভারতের ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ সাময়িকীতে সে দেশের পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক শ্রীরাধা দত্ত এক নিবন্ধে লেখেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত কখনো নাক গলায় না, এই মিথটাকে বেআব্রু করে দিয়েছিল শেখ হাসিনাকে ভারতে নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার ঘটনায়।’

তিনি আরো লিখেছেন, বিগত দেড় দশক ধরে ভারতের সমর্থনেই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। বাংলাদেশে জল্পনার আকারে থাকা এই মতবাদটা এখন একধরনের ‘কনফার্মেশন’ পেয়ে গেছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন এবং এ কারণেই ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক তিক্ত থেকে তিক্ততর হচ্ছে।

মানবতা.বি.রো.ধী অ.প.রা.ধী পলাতক হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার পর থেকেই ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা বাংলাদেশকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করার হুমকীও দিচ্ছেন।

ভারতের সোস্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে মূল ধারার মিডিয়াগুলোতেও অনবরত বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানীমূলক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকীও দিচ্ছে ভারতের কিছু কিছু মিডিয়া। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানোর ব্যবস্থার কথা বলতেও দ্বিধা করেননি।

দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও বেশি নেতিবাচক সম্পর্কের দিকে উস্কে দেওয়া হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা নেতিবাচক সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে।

ভারত শুধু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েই থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একতরফা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। এখন প্রতিদিন ভারতে বসবাসকারী বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে জোর করে বাংলাদেশে পুশ ইন করছে।

এসব কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধী অবস্থান প্রকাশ্যেই প্রকট আকার ধারণ করেছে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখন ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। ভারত বিরোধীতাকে এখন রীতিমত বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই এতোদিন মনের ভেতর চেপে রোখা ভারত বিরোধীতা এখন নির্দ্বিধায় প্রকাশে করছেন বাংলাদেশের আমজনতা।

মানুষের মধ্যে যে কারণে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতারা ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রেখে রাজনীতি করার বক্তব্য দিলে, তা নিয়ে নানা সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

এর বিপরীতে সরকারের দায়িত্বশীল কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে ভারত বিরোধী বক্তব্যে দেয়া হলে সে সব বক্তব্য ইতিবাচক সমর্থনের প্রবনতা দেখা যাচ্ছে অনলাইনসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

২০২৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশে ভারতপন্থি ও পাকিস্তানপন্থি কোনো রাজনৈতিক দলের ঠাঁই হবে না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে বিনির্মাণ করব।

নাহিদ আরও বলেন, জুলাই ২০২৪-এ ছাত্র-জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ফ্যা.সি.বা.দী সরকারের পতন ঘটিয়েছে।

নাহিদ বলেন. আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি।’

তিনি বলেন,রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যা.সি.বা.দী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে জনগণ একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা কারণে ভারত বিরোধিতার বিষয়টি এখন প্রবল আকার ধারণ করেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি আবার নতুন করে উস্কে দিচ্ছে কোন কোন রাজনৈতিক দলের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডেও।
……………………….
এফ শাহজাহান,

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ