লেখক, জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
একজন মানুষ, যিনি নিজের অস্তিত্বকে পেছনে ঠেলে সামনে ঠেলে দেন সন্তানের স্বপ্নকে—তাঁকেই আমরা বাবা বলি। বাবা শব্দটি উচ্চারণে যে দৃঢ়তা, যে আশ্রয়, যে আস্থা জড়িয়ে থাকে, তা একান্তই অভিজ্ঞতার জিনিস; ভাষায় ধরতে গেলে তা ঝরে পড়ে, রয়ে যায় নিঃশব্দ ব্যথার মতো।
আমার বাবাকে আমি চিনি না জন্মের চোখ খুলেই। আমি যখন মায়ের গর্ভে, তখন আমার বাবা হাজার মাইল দূরে, পরদেশে, জীবনের এক অন্যরকম জিহাদে লিপ্ত। তিনি দেশ ছাড়েন কোনো বিলাসের জন্য নয়, কোনো স্বপ্নের রঙিন প্রচ্ছদে মোড়া উচ্চাশার জন্য নয়—তিনি যান একজন অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করে তুলতে, এক অনলস সংগ্রামের পথে, যেখানে সকাল-সন্ধ্যা গলে যায় আমাদের হাসিমুখের বিনিময়ে।
আমি তাঁকে দেখি সাত বছর বয়সে। প্রথম দেখার সেই মুহূর্ত যেন আজও আমার শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত। কোনো বড় বিস্ময় নয়, বরং এক নীরব গ্রহণযোগ্যতা—এই মানুষটিই আমার জনক, যিনি সাত বছর ধরে আমার মুখ না দেখেই ভালোবেসে গেছেন, আমার শ্বাসপ্রশ্বাসে নিজের পরিশ্রম জুড়ে দিয়েছেন, আমার ভবিষ্যতের প্রতিটি খুঁটিনাটিতে বিনিয়োগ করেছেন তাঁর আজন্ম স্বপ্ন।
আমার বাবা কখনো নিজেকে অগ্রাধিকার দেননি। আমাদের ভালো থাকা, আমাদের পড়ালেখা, আমাদের সামান্যতম ইচ্ছার প্রতিও তিনি থেকেছেন অবিচল, নিঃশর্ত। নিজে হয়তো বছরের পর বছর পরনে পুরোনো জামা, খাবারের মাঝে সংযম—কিন্তু আমাদের জন্য তাঁর হৃদয় উন্মুক্ত ছিল সমুদ্রের মতো। আমরা যখন ঘুমিয়েছি নিশ্চিন্তে, তখন তিনি ছিলেন জেগে থাকা একজন অভিভাবক, যাঁর প্রহরায় আমাদের জীবন নিরাপদ।
আমি সৌভাগ্যবান—আমার বাবা আমাকে এমন এক শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যার ভিত্তি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক মান নয়, নৈতিকতাতেও অনন্য। আমি পড়েছি দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান দারুননাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসায়, এবং আজ আমি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। এই পথটি মসৃণ হয়নি কোনো ম্যাজিকের জাদুতে—এ পথ গঠিত হয়েছে আমার বাবার প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি ঘামের বিনিময়ে।
বাবা আমার জীবনে শুধু একজন উপার্জনকারী নন, তিনি এক সুশীতল ছায়া, এক চলমান প্রার্থনা, এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি কেবল দায়িত্ব পালনের জন্য পিতা হননি, তিনি হয়েছেন আমার অস্তিত্বের প্রধান স্তম্ভ।
আজ বাবা দিবসে আমার কোনো উপহার নেই তাঁর জন্য। শুধু এই কলমভরা ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা আর একান্ত প্রার্থনা—
হে পরম করুণাময়, আমার বাবাকে নেক হায়াত দান করুন। তাঁকে সুস্থ রাখুন, শান্তিতে রাখুন। তাঁর ছায়া যেন আমার জীবনে অনন্তকাল বয়ে চলে এক আশীর্বাদের বাতাস হয়ে।