১৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

শিরকি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ইমাম, বিশ্বাসের মসজিদে অবিশ্বাসের আগুন 

spot_img

 

 

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

বাংলাদেশের নানা প্রান্তে এমন খবর শোনা যাচ্ছে কিছু মসজিদের ইমাম কবরস্থানে উলঙ্গ হয়ে তাবিজ পুঁতে রাখেন, জিন-পরীর উদ্দেশ্যে ‘আচার’ পালন করেন, কিংবা অলৌকিক শক্তির দাবিতে কুসংস্কারে মগ্ন থাকেন। এ যেন ধর্মের পবিত্র মিনার থেকে শিরক ও বিভ্রান্তির ধোঁয়া উঠছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এমন কাজ শুধু গুনাহ নয়, বরং সরাসরি আকীদার বিপর্যয় যা একজন মুসলমানকে ঈমানের গণ্ডির বাইরে নিয়ে যেতে পারে।

ইসলাম উলঙ্গতা ও কুসংস্কারের প্রতি যে ঘৃণা প্রদর্শন করেছে, তা স্পষ্ট ও নির্দ্বিধা।

 

নবী করিম সা. বলেছেন,

“তোমরা তোমাদের লজ্জাস্থান আচ্ছাদিত রাখবে, আল্লাহকে ভয় করো।” (তিরমিজি, হাদীস ২৭৯৪)

 

অন্য হাদীসে তিনি বলেন, “আল্লাহ মানুষকে নগ্ন অবস্থায় নয়, পোশাক পরা অবস্থায় লজ্জাশীল হতে ভালোবাসেন।” (ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৪০০২)

কবরস্থানের মতো মর্যাদাপূর্ণ স্থানে নগ্ন হওয়া আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি অবমাননা, যা গুনাহে কবীরা।

কবরস্থানে তাবিজ পুঁতে রাখা বা জিন-পরীকে তুষ্ট করার মতো কাজ ইসলামে শিরকের পর্যায়ে পড়ে।

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ঘোষণা করেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে, সে শিরক করে।”(সূরা আল-জিন, ৭২:৬)

আরেক জায়গায় বলেন, “নিশ্চয়ই জাদুকর সফল হয় না যেখানেই সে আসে।”

(সূরা ত্বাহা, ২০:৬৯)

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা রহ. স্পষ্টভাবে লিখেছেন, “যে ব্যক্তি কবরস্থানে তাবিজ, রক্ত বা কোনো বস্তু পুঁতে দেয় এই বিশ্বাসে যে তাতে কোনো প্রভাব ঘটবে, সে আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করেছে।” (মাজমূআ ফাতাওয়া, খণ্ড ২৭, পৃ. ৭২)।

ইমাম ইবনে কাসির রহ. বলেন, “কবর, তাবিজ ও জাদুবিদ্যা এগুলো শয়তানের পথ। যে ব্যক্তি এগুলোর ওপর নির্ভর করে, সে আল্লাহর আশ্রয় হারায়।” (তাফসির ইবনে কাসির, সূরা আল-বাকারা ১০২ আয়াতের ব্যাখ্যা)

এমন কর্মকাণ্ড যারা করে, বিশেষ করে যদি তারা ধর্মীয় নেতা বা ইমাম হন, তবে তা মুসল্লিদের ঈমানের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি। কারণ ইমাম মানে হচ্ছে পথপ্রদর্শক। যখন পথপ্রদর্শকই অন্ধকারে হারিয়ে যায়, তখন অনুসারীরাও বিভ্রান্ত হয়।

ইমাম নওয়াবী রহ. লিখেছেন, “যে ব্যক্তি শিরকি কাজ করে এবং তাওবাহ করে না, তার পিছনে নামাজ সহীহ নয়। মুসল্লিদের উচিত এমন ইমামকে অপসারণ করা।” (আল-মাজমূ‘, খণ্ড ৪, পৃ. ২৮৯)

ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মাযহাবে বলা হয়েছে, যদি ইমাম প্রকাশ্যে কুফরি কাজ করে, তবে তার ইমামতি বাতিল হবে এবং মুসল্লিরা তার পিছনে নামাজ আদায় করতে পারবে না। (ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া, খণ্ড ১, পৃ. ৮৪)

তাহলে প্রশ্ন জাগে মসজিদে যদি এমন ইমাম থাকেন যিনি কবরস্থানে গিয়ে তাবিজ পোঁতার মতো শিরকি কাজ করেন, তবে মুসল্লিদের কী করা উচিত? ইসলামী শরীয়তের রায় হলো, প্রথমত, তাকে প্রমাণসহ সতর্ক ও উপদেশ দিতে হবে, দ্বিতীয়ত, সে যদি তাওবাহ না করে, তাহলে তাকে ইমামতির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কারণ নামাজ এমন ব্যক্তির পিছনে সহীহ নয়, যিনি শিরক বা কুফরির কাজে লিপ্ত।

আজ আমাদের সমাজে সবচেয়ে বড় সংকট জ্ঞানের নয়, বরং বিশুদ্ধ আকীদার। কুসংস্কার, যাদুবিদ্যা, তাবিজ, হুজুরপনা এসবের মাধ্যমে ইসলামকে বিকৃত করা হচ্ছে। অথচ ইসলাম হল তাওহীদের ধর্ম, যেখানে বিশ্বাসের কেন্দ্র একমাত্র আল্লাহ।

নবী সা. বলেছেন, “যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলায়, সে শিরক করেছে।” (আহমদ, হাদীস: ১৭৪৪০)

মসজিদ হলো ঈমানের দুর্গ। কিন্তু যদি সেই দুর্গের মেহরাবে দাঁড়ানো মানুষই শিরককে আশ্রয় দেন, তাহলে তা আল্লাহর ঘরে অবিশ্বাসের আগুন জ্বালানোর শামিল। এই বিপর্যয় রোধে সমাজের দায়িত্ব হলো ইমাম নির্বাচন কঠোর করা, আকীদা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, এবং ধর্মীয় প্রতারণার মুখোশ উন্মোচন করা।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।” (সূরা আত-তাওবা, ৯:১১৯)

এ সময়ের সত্যবাদিতা হলো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নির্ভীক অবস্থান নেওয়া। কারণ শিরক শুধু ব্যক্তির ঈমান ধ্বংস করে না, পুরো জাতির আত্মিক শক্তি নষ্ট করে দেয়। একজন ইমামের হাতে যদি শিরক প্রবেশ করে, তাহলে তার জিহ্বা থেকে উচ্চারিত “আল্লাহু আকবার”ও বিশ্বাসের ওজন হারায়।

এখন সময় এসেছে মসজিদ ও সমাজে ঈমানের শুদ্ধি অভিযানের। কুসংস্কার নয়, কুরআনই হবে দিকনির্দেশনা, তাবিজ নয়, তাওহীদই হবে ভরসা। ইসলাম কোনো আচার নয়, এটি এক অবিচল বিশ্বাসের নাম যেখানে কোনো তাবিজ, কবর বা উলঙ্গ আচার নয়, বরং কেবল আল্লাহর ইবাদতই সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী।

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ