
সাংবাদিক, কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকারের রহস্যজনক নিখোঁজের খবরে প্রথমেই ‘গুম’ বা ‘হত্যা’ শব্দ দুটি নিউরনে ঘুরছিল। তবে মেঘনায় মরদেহ পাওয়ার পর বিস্মিত হলাম। তাৎক্ষণিক ভাইরাল হওয়া তার ‘খোলা চিঠি’ পড়তে গিয়ে চোখ ভিজল। ফেসবুকে ঝড়ের মতো পোস্টের ৯৯ ভাগই সংবাদকর্মীদের। অবাক হয়ে দেখলাম, ‘ব্যক্তি’ সাংবাদিক মিলিয়ে গিয়ে ফেসবুকে ভেসে উঠছে ‘দলীয়’ বিভুরঞ্জন।
রাতেই তার চিঠির বিশেষ অংশের পোস্টের ছড়াছড়ি। কেউ পদন্নোতি কোট করলেন, “আজকের পত্রিকায় কাজ করছি ৪ বছর হলো। এই সময়ে না হলো পদোন্নতি, না বাড়ল বেতন।” কেউ বেতন বৈষম্য, “শুনেছি, আমার বিভাগীয় প্রধানের বেতন আমার প্রায় দ্বিগুণ। আহা, যদি ওই বেতনের একটি চাকরি পেতাম!” হতাশা কোট করলেন অনেকে, “সাংবাদিক হিসেবেও এ-ডাল ও-ডাল করে কোনো শক্ত ডাল ধরতে পারিনি।”
গভীর রাতে পড়লাম, Maskwaith Ahsan-এর পোস্ট “বিভুরঞ্জন সরকারের ধূসর পাণ্ডুলিপি” আর Hasan Al Mahmud-এর “বিভুরঞ্জন সরকারের আত্মহত্যা প্রসঙ্গে”। এছাড়া আরও বহু মূল্যায়ন। ধীরে ধীরে বিভু ইস্যুতে পরিষ্কার হলো “শেখ হাসিনা” পক্ষ বনাম “প্রফেসর ইউনূস” পক্ষ, “আওয়ামী” বনাম “জুলাই গণঅভ্যুত্থান”। হিসাব কষে দেখলাম, তিনটি পক্ষ মুখোমুখি- একপক্ষ “সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়” লিখে কার্ড ছাড়ল। আরেক পক্ষ, বিভুরঞ্জনের লেখা “শেখ হাসিনা: স্বপ্নপূরণের সফল কারিগর” বইয়ের প্রচ্ছদ ভাইরাল করল।
আর তৃতীয় পক্ষ (হতভাগা সংবাদকর্মীরা) পোস্টাতে লাগলেন, “আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই…কোথাও না কোথাও বড় ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি আর কাটিয়ে ওঠা হলো না।” পড়তে পড়তে রাতে মাথা ভারী হয়ে গেল। সকালে উঠে দেখি সিনিয়র রিপোর্টার A Gofur Aronna-এর পোস্ট “একজন তথ্য সন্ত্রাসীর করুণ বিদায়” নিয়ে সমালোচনা। যেখানে বিভুরঞ্জনকে “ফ্যাসিস্ট” আখ্যা দিয়ে বসেছেন।
অনলাইন খুলে বিভুরঞ্জনের স্ত্রীর ভাই দীপঙ্কর সাহার মন্তব্য পড়লাম। তিনি চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, “চিঠিটি তারা আগে দেখেননি। যদি দেখতেন, তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতেন না।” ছেলে ঋত সরকার বলেছেন, “বাবা হতাশাগ্রস্ত ছিলেন কি না, সেটি আমরা ঠিক বলতে পারছি না।” ছোট ভাই চিররঞ্জন সরকারের আপেক্ষ, “এমন পরিণতি যেন আর কারও না হয়। ”
ফের ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম, সংবাদমাধ্যমের সংকটকে গভীর কাঠামোগত হিসেবে উল্লেখ করে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর দেওয়া পোস্ট শেয়ার করছেন অনেকে। যেখানে হাসনাত লিখেছেন, “সাংবাদিকদের দিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক দালালি করানো হয়। এর সঙ্গে রয়েছে করপোরেট নেক্সাস।”
রাতে পড়া মাসকাওয়াথ আহসানের (Maskwaith Ahsan) কথাগুলো মনে পড়ল, “দেশের কুসস্কারাছন্ন ও অন্ধবিশ্বাস নির্ভর সমাজে রাজনৈতিক বিশ্বাসগুলো ধর্মীয় আঙ্গিকে প্রতিপালিত। যা স্ব স্ব রাজনৈতিক ধর্মকে নির্ভুল বলে ভাবতে শেখায়। এমন অন্ধবিশ্বাসনির্ভর বিজন জনপদে সাংবাদিকতা দলীয় সত্যের ওপর নির্মিত। ফলে এখানে নৈর্ব্যক্তিক সাংবাদিকতা সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। দলীয় সেবাদাস দলের মন্দিরে ফুল দিয়ে এসে রিপোর্ট ও কলাম লেখে। সেটা সাংবাদিকতা তো নয়; দলীয় প্রোপাগান্ডা মাত্র।”
মজাটা হচ্ছে, বিভুরঞ্জনকে নিয়ে পোস্টদাতাদের ৯৯ ভাগই সাংবাদিক। আর তাদের প্রায় ৯৯ ভাগই সাংবাদিকতায় প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে অথবা অবচেতনে দলীয় আদর্শের সেবাদাস। দলের মন্দিরে ফুল-চন্দন দিয়ে এসেই তারা প্রতিবেদন তৈরি করেন কিংবা ‘নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ’ কলাম লেখেন। ব্যক্তি ভুলে গিয়ে দলীয় বিভুরঞ্জনকে নিয়ে লীগ লেন্সের সাংবাদিকদের সরবতা আর বিএনপি-জামায়াত লেন্সের মুখরতা যার বড় প্রমাণ।
লেখক : নিয়ন মতিয়ুল, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট (২৩ আগস্ট, ২০২৫। এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা)