হিট অফিসার কি পারবেন তার কাজ ঠিকমতো করতে?
কয়েক দিন ধরেই আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশে একজন চিফ হিট অফিসার নিয়োগের সংবাদ। এটি নিঃসন্দেহে একটি দারুণ সংবাদ। আধুনিক বিশ্বে এমন অনেক অনেক নতুন ডেজিগনেশন বা পদবির আবিষ্কার হচ্ছে। তা হতেই পারে। কোন পদ কেন সৃষ্টি হচ্ছে সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের জ্ঞান বা জানার আগ্রহ একদম নিচের দিকেই থাকে। আর এমনিতেই আমরা নতুন কিছুকে সহজে গ্রহণ করতে পারি না। প্রচুর নেতিবাচক আলোচনায় তবে থিতু হয় এক জায়গায়। আর ডিজিটাল মিডিয়াকালে তো কোনও বিষয়ই আলোচনা ছাড়া থাকছে না।
উত্তর সিটি করপোরেশনের চিফ হিট অফিসার নিয়োগের ফলে আমাদের জানা ও বোঝার পরিধিও বাড়ছে বৈকি। এই পদটির সঙ্গে মোটেও পরিচিত ছিলাম না আমরা। উত্তর সিটি করপোরেশন বুশরা আফরিনের নিয়োগের ঘোষণা করার পরেই জানার রাস্তাটা খুলে গেলো। পদটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার। বিভিন্ন দেশের আরও ছয়টি শহরে একইভাবে হিট কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই কর্মসূচির লক্ষ্য, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষকে চরম তাপমাত্রা থেকে রক্ষা করা।
আমার আলোচনার বিষয় বুশরার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে নয় বা তিনি যে মেয়রের কন্যা সেটিও নয়। আমার আলোচ্য বিষয় এই পদের কাছে প্রত্যাশা নিয়ে। আজকের পত্রিকায় সংবাদ হচ্ছে বায়ুদূষণে বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার আজকের অবস্থান দশম। আর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী ঢাকার এই বায়ুদূষণের মাত্রা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। গোটা দেশে এখন চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলছে। বাইরে বের হওয়াই এখন বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধুলার মিশ্রণ। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছে ইটভাটা, যানবাহনের ধুলা আর নির্মাণকাজের ধুলা। পরিবেশ অধিদফতর আর বিশ্বব্যাংকের এক যৌথ প্রতিবেদনে এই কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জলাশয় দখল আর গাছ কাটাও কি বড় ভূমিকা রাখছে না এই ক্ষেত্রে? আমাদের চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের একটি সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম পত্রিকায়। তিনি তার প্রধান কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন জনগণকে পরিবেশের নানা ইস্যুতে সচেতন করা। আর এই সচেতনতা তারা করতে চান ডিজিটাল যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু কেবল সচেতন করেই কি এই প্রবল সমস্যার সমাধান করা যাবে? এর উত্তরেও তিনি বলেছেন বেশি করে গাছ লাগানোর কথা। সুপেয় পানির ব্যবস্থার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কাজ করতে চান।
সমস্যাটা সম্ভবত হবে এখানেই। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তিনি ফেইস করবেন এই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গেই। ওয়াসার বিরুদ্ধে বড় বড় প্রজেক্টে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। মাটির ক্ষয় থামাতে গভীর নলকূপের মাধ্যমে নিচ থেকে পানি উঠানোর বিকল্প তৈরির একটি বড় লক্ষ্য ছিল ওয়াসার। কিন্তু জানা গেলো সেটি তো হয়ইনি; বরং মাটির গভীরতা নামতে নামতে এখন বিপৎসীমা বরাবর অবস্থান করছে। অর্থাৎ, আমরা মাটিকেও মেরে ফেলার ব্যবস্থা করছি। মাটির কাছ থেকে পানি টেনে নিয়ে আসছি নিজেদের জীবন বাঁচাতে, কিন্তু মাটির নিজের স্বাস্থ্যের জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন সেটিও রাখছি না আমরা। ফলাফল দিনে দিনে মাটি হারাচ্ছে তার প্রাণশক্তি। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার জন্য এটা কতটা সহায়ক?
সিটি করপোরেশন লাখ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিচ্ছে অথচ যে গাছগুলো এখন রয়েছে সেগুলোকে যে একেক কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো করে কেটে ফেলছে তার কী হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শতবর্ষের স্মারক তৈরির জন্য মল চত্বরের অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এর পরিবর্তে কি নতুন কোনও গাছ রোপণ হয়েছে? অথবা গাছ কেটেই কেন স্মারক বানানো লাগবে? আমরা বাইরের দেশের সংবাদ পাই যেখানে গাছকে মেরে না ফেলে রিলোকেট করে দিচ্ছে। অথচ আমরা ধরেই কেটে ফেলছি সহজে। ধানমন্ডির মতো একটি পুরনো এলাকার সাতমসজিদ রোডের ডিভাইডার তৈরির নামে গাছ কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে। সংবাদ সম্মেলন করছে। আর এই গাছ কাটছে কারা? দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
উত্তর সিটি করপোরেশন চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দিচ্ছে, ২ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছে, আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সৌন্দর্য বর্ধনের নামে গাছ কাটার যজ্ঞ চালাচ্ছে। গাছ কাটার অভিযোগ আছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও। স্বয়ং বন বিভাগের বিরুদ্ধেও কম অভিযোগ নাই।
তাহলে এই যখন অবস্থা তখন একজন বুশরা আফরিন কতটা কী করতে পারবেন? আর যেসব শহরে চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেসব দেশে তো “গভর্ন্যান্স” বলে একটা শব্দ আছে, যা সবাই মানে ও মেনে চলে। কিন্তু আমাদের দেশে কি সেটা আছে? এক আনিসুল হকের মুখেই আমরা শুনেছিলাম হতাশার কথা। তিনি চাইলেও কোন উন্নয়ন কর্ম হাতে নিতে পারেন না কেবল সংশ্লিষ্ট “কর্তৃপক্ষ”কে এক টেবিলে আনা যায় না বলে। আর এই আনা না যাওয়ার ফসল ভোগ করছি আমরা সাধারণ মানুষ। সারা বছর রাস্তার কাজ চলতে থাকে। রাস্তায় ধোঁয়া বের করে চলছে ভাঙাচোরা অচল গাড়ি। যে যার ইচ্ছেমতো গাছ কেটে সাফ করে দিচ্ছে।
এই যে বারোয়ারি কর্তৃপক্ষের দৌরাত্ম্য, সেখান থেকে এই শহরকে সুস্থ অবস্থায় বের করে আনা কি সহজ হবে আমাদের চিফ হিট অফিসারের জন্য?