
বছরের বেশিরভাগ সময় যখন দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো পড়ে থাকে শূন্যতায়, তখন ঈদ এলেই যেন প্রাণ ফিরে পায় ঢাকাই চলচ্চিত্র। সিনেমা হলে বাড়ে দর্শকের ভিড়, মুক্তি পায় আলোচনায় থাকা কিংবা জমে থাকা ছবি, আশায় বুক বাঁধেন হল মালিক থেকে নির্মাতা ও প্রযোজকরা। এই পুনরাবৃত্ত চিত্র বারবারই প্রমাণ করে—ঢালিউড এখন একপ্রকার ‘ঈদনির্ভর’ ইন্ডাস্ট্রিতে রূপ নিয়েছে।
ঈদ মানেই যেন সিনেমা বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা
ছবির বাজার বিশ্লেষণ বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে মুক্তি পাওয়া ২৩টি সিনেমার মধ্যে ব্যবসা করতে পেরেছে মাত্র ৪-৫টি, যা অধিকাংশই ঈদের সময় মুক্তি পাওয়া ছবি। ঈদের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে সফল এমন সিনেমার সংখ্যা কার্যত নেই। মাল্টিপ্লেক্সগুলো কোনোমতে বিদেশি ছবি চালিয়ে টিকে থাকলেও সিঙ্গেল স্ক্রিন হলগুলোর অবস্থাই বেশি করুণ—বছরের বাকি সময় প্রায় বন্ধই থাকে।
স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা সারা বছরই ছবি চালাতে চাই, কিন্তু ছবি-ই আসে না। সবাই শুধু ঈদের জন্য ছবি রিলিজ করতে চান, বছরের অন্য সময় যেন ছবির বাজারই নেই!”
মধুমিতা হলের মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদও আক্ষেপ করে বলেন, “শুধু দুই ঈদে হলে দর্শক থাকে, এরপর বাকি সময় হল বন্ধ রাখতে হয়। কারণ নতুন ছবি নেই, দর্শকও নেই।”
সবাই ঈদেই মুক্তি দিতে চান—বাকি সময় যেন অভিশপ্ত
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশির ভাগ পরিচালক, প্রযোজক ও নায়ক মনে করেন, ঈদেই সিনেমা মুক্তি দিলে দর্শক পাওয়া যাবে। ঈদের বাইরে ছবি মুক্তি দিতে যেন একরকম ভয় কাজ করে তাদের মধ্যে। অথচ ‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘হাওয়া’, ‘দেবী’র মতো দর্শকপ্রিয় সিনেমাগুলো কিন্তু ঈদের বাইরে মুক্তি পেয়েই আলোড়ন তুলেছিল।
তারকারাও এখন শুধুই ‘ঈদমুখী’
বর্তমানে ঢালিউডের প্রধান তারকাদের মধ্যে যেমন শাকিব খান, সিয়াম আহমেদ, আফরান নিশো, শবনম বুবলী, পূজা চেরি—তাদের সবারই লক্ষ্য থাকে সিনেমা ঈদে মুক্তি দেওয়ার। ঈদের বাইরের মুক্তিকে অনেকেই ঝুঁকি হিসেবে দেখেন। অথচ ভালো গল্প আর নির্মাণ থাকলে ঈদের বাইরেও দর্শক টানা সম্ভব, তা প্রমাণ করেছে আগের বেশ কয়েকটি হিট সিনেমা।
দায় কার? সমাধানই বা কী?
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, ঈদের বাইরের সময়গুলোতে বড় প্রযোজক ও তারকারা ছবি মুক্তিতে আগ্রহী না হওয়াই এই সংকটের অন্যতম কারণ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বাজেট সংকট, দুর্বল বিপণন, নির্মাণের বৈচিত্র্যহীনতা ও সিনেমা হলের দুরবস্থা।
চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, “৫২ সপ্তাহের মধ্যে মাত্র ৬ সপ্তাহ সিনেমা চলে—এই ব্যবস্থায় ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকতে পারে না। ছবি বানানোর জন্য দরকার ভালো শিল্পী, পরিচালক, গল্প এবং সারা বছর ধরে সক্রিয় প্রেক্ষাগৃহ।”
মেসবাহ উদ্দিন মনে করেন, “প্রতি মাসে নতুন ছবি মুক্তি পেলে দর্শক নিজের মতো পরিকল্পনা করে হলে আসবে। আমরা যখন বাংলা ছবি না পাই, তখন বিদেশি ছবি চালাই—সেই সময়েও কিন্তু দর্শক আসে। ছবি না আসলে দর্শক আসবে কীভাবে?”
পরিচালক রায়হান রাফীর মতে, “দর্শককে হলে ফেরাতে হলে অভ্যাস গড়তে হবে। আমরা চেষ্টা করছি। ঈদের বাইরে ভালো গল্প আর বাজেটের ছবি এলে দর্শক আসবেই।”
শেষ কথা
ঈদের সিনেমা সফল মানেই যে ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়িয়েছে—তা নয়। বরং এটি প্রমাণ করে, ঢালিউড এখনো বারো মাসের টেকসই দর্শকগোষ্ঠী গড়ে তুলতে ব্যর্থ। তাই শুধু ঈদনির্ভর না হয়ে সারা বছর ধরে নির্মাণ, বিপণন এবং মুক্তির পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। নয়তো বাকি দশ মাস সিনেমা হলগুলো শূন্যই পড়ে থাকবে, আর ঢাকাই সিনেমা হারাবে তার অস্তিত্ব।