৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ছুরি ইসরায়েল, হাত আমেরিকা, গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে একটি সভ্যতার মুখোশ

spot_img

লেখক: জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

যখন গাজার আকাশ ছিঁড়ে নামে আগুনের বৃষ্টি, তখন শিশুর মুখে একটাই প্রশ্ন—আমি কেন? তার চোখে জমে ওঠে বিস্ময়ের অশ্রু, মায়ের কোল ভিজে যায় সন্তান হারানোর উত্তপ্ত রক্তে, আর শহরজুড়ে বাজতে থাকে মৃত্যুর নৈশবাহিনী। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞের ভেতরে ইসরায়েলের একার ছায়া পড়ে না। এই ছায়া অনেক দীর্ঘ, অনেক গভীর। এই ছায়ার উৎস আমেরিকা—সেই হাস্যোজ্জ্বল ঘাতক, যে মানবাধিকারের বুলি কপচাতে কপচাতে নির্মমতার এক অনন্ত আয়োজন করে চলে।

ইসরায়েল কেবল একটি ছুরি—চালক নয়। সে আগ্রাসন করে, কারণ তাকে বলা হয়। সে হত্যা করে, কারণ হত্যায় মদদ মেলে। আর এই মদদ আসে সেই হাত থেকে, যে হাত একদিকে জাতিসংঘের সনদ ধরে রাখে, অন্যদিকে ছুরির হাতলে দৃঢ়ভাবে চেপে বসে। হোয়াইট হাউসের দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে আছে গাজার অসংখ্য স্বপ্ন, পেছনের অন্ধকার করিডোরে লুকিয়ে আছে সেই নির্দেশ, যার একেকটি শব্দ একেকটি প্রাণহানির অনুবাদ।

ইসরায়েলের জন্ম ছিল এক পরিকল্পিত পাপ—ভূরাজনৈতিক দাবার ছকে মার্কিন আধিপত্যের মোহর বসাতে। ১৯৪৮ সালে জন্ম হয় এক রাষ্ট্রের, যার মূলতত্ত্বেই ছিল অপরের ভূমি দখলের অধিকার। আর সেই অধিকারের নিরাপত্তা দিতে, গায়ের জোরে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তরাষ্ট্র তার সমস্ত বাহুবল নিয়োজিত করে। অর্থ, অস্ত্র, প্রচার ও প্রভাব—সবকিছু দিয়েই গড়ে তোলে এক কৃত্রিম দৈত্য, যার ক্ষুধা কেবল রক্ত, যার রাজনীতি কেবল মৃত্যু।

গাজা সেই পরীক্ষাগার, যেখানে প্রতিটি বোমা আগে ফেলা হয়, তারপর তার ক্ষমতা মাপা হয় মার্কিন কন্ট্রাক্টরদের ডেস্কে। প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ মানে একটি পণ্যদ্রব্যের পরীক্ষামূলক বাজার। এখানে শিশুদের কান্না পরিণত হয় পরিসংখ্যানে, শহীদদের নাম মুছে যায় রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদন থেকে। মিডিয়া যেভাবে শিরোনাম বেছে নেয়, সেভাবেই নির্মাণ হয় সত্যের মুখোশ—যেখানে ‘দুই পক্ষের সংঘর্ষ’ লেখা থাকে, কিন্তু আসলে চলে একতরফা নিধনযজ্ঞ।

আর যারা বলে—‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা’, তারা যেন এক হাতে হত্যা করে, আর অন্য হাতে চোখ মুছে দেয়। এই ভণ্ডামির চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখি যখন একদিকে ভিয়েতনামে আগুন লাগে, অন্যদিকে ওয়াশিংটনে শান্তির নোবেল বিতরণ হয়। একই গল্প চলে ইরাকে, আফগানিস্তানে, সিরিয়ায়। এবং আজ—ফিলিস্তিনে। পৃথিবী জুড়ে আমেরিকার যাত্রাপথ মানেই সভ্যতার চিহ্ন রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের ওপর। তাদের গণতন্ত্র মানে শক্তিশালীকে রক্ষা করা, আর দুর্বলকে চুপ করানো।

ইসরায়েলের প্রতি এই অবিচল আনুগত্য কেবল লবির প্রভাব নয়—এ এক পরজীবী সম্পর্ক। যেখানে ফিলিস্তিনের প্রতিটি মৃত্যু হয়ে ওঠে মার্কিন সামরিক শিল্পের জন্য নতুন পণ্যের বিজ্ঞাপন। যেখানে প্রতিরোধ মানেই ‘সন্ত্রাসবাদ’, আর দখল মানেই ‘আত্মরক্ষা’। এই ভাষার ছলনায় বিশ্বজুড়ে কেবল শব্দ নয়, বিবেকও হারিয়ে যায়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই সত্য জানার পরও কেন বিশ্ব চুপ? কারণ এই চুপটি বিক্রি হয়ে গেছে। এই নীরবতা আজ সুরক্ষিত বাণিজ্যচুক্তিতে বন্দী, মিডিয়ার কর্পোরেট আগ্রহে পিষ্ট, আর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মেরুদণ্ডহীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের শীতল নিষ্ক্রিয়তায় জড়ানো।

আজ যারা কেবল ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, তারা যেন বুঝে—ছুরির ধার যতই ধারালো হোক, আসল ভয় ছুরির হ্যান্ডেলে। আর এই হ্যান্ডেল আজও দৃঢ়ভাবে আমেরিকার হাতে। গাজায় যদি মৃত্যু হয়, তবে তার হুকুম আসে ওয়াশিংটনের কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে থাকা ব্যক্তির ঠাণ্ডা স্বরে।

ইতিহাস কোনো দিন চুপ থাকে না। সে দেখে, সে লিখে রাখে। আজ যদি আমরা এই খুনিদের গায়ে সুসভ্যতা দেখেও চুপ থাকি, তবে আগামী প্রজন্ম আমাদের জানবে সেই জাতি হিসেবে, যারা সত্য দেখেও চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।

এখন সময় এসেছে এই মুখোশ ভাঙার। সময় এসেছে সাহস করে বলার—ইসরায়েল কেবল এক দানব নয়, সে এক দাস; আর তার প্রভু বসে আছে ‘স্বাধীনতার মূর্তিপরিচয়’ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে।

যে সাম্রাজ্য গাজার রক্ত দিয়ে কাচ মুছে দেখে তার বৈদেশিক নীতি ঠিকঠাক চলছে কিনা।

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ