৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে বিএনপিতে ত্রিভুজ প্রেমের রসায়ন

spot_img

পলাতক ফ্যা.সিবাদ ফেরাতে ফানাফিল্লাহ হয়ে উঠেছে বিএনপি। ফ্যা.সিস্ট আওয়ামী লীগ এবং ফ্যা.সিস্টের দোসর জাতীয় পার্টিকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে শহীদ হতেও রাজি আছেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড বা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা বিএনপি সমর্থন করে না। যারা জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা চাচ্ছে,তারা সেই অভিযোগটা আদালতে উত্থাপন করতে পারে।

জাতীয় নির্বাচন এলেই জাতীয় পার্টিকে নিয়ে খেলা শুরু হয়। প্রতি বছর আওয়ামী লীগ একাই খেলতো। এবার আওয়ামী লীগ নেই। সেই শুন্যস্থান পূরণ করেছে বিএনপি। তবে পলাতক আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে না থাকলেও পর্দার আড়ালে থেকে তারাও জাতীয় পার্টির ওপর ভর করে দৃশ্যপটে ফেরার চেষ্টা করছে।

এরফলে আসন্ন ত্রয়োদ্বশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি-বিএনপি-আওয়ামী লীগের ত্রিভূজপ্রেমের রসায়ন বেশ জমে উঠেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি বরাবরই একটি “কিংমেকার” বা ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সামরিক শাসন এবং দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈর শাসনের উত্তরাধিকার বহন করলেও দলটি টিকে আছে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক প্রয়োজনের কারণে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে জাতীয় পার্টিকে সহযোগী বিরোধী দল হিসেবে ব্যবহার করে সংসদে অংশগ্রহণমূলক চিত্র তৈরি করেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে তাদের ভূমিকা নির্বাচনের আংশিক বৈধতা নিশ্চিত করেছে। এভাবে পর পর ৩টি বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশের ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদ কায়েমের পথ সুগম করেছে।

অপরদিকে, আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর বিএনপিও জাতীয় পার্টিকে সক্রিয় রাখতে কৌশল নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বহুদলীয় রাজনীতি প্রদর্শন, সংসদীয় ভারসাম্য রক্ষা করা এবং আওয়ামী লীগের মতই জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়া এবং টিকে থাকার জন্য জাতীয় পার্টিকে তোয়াজ করছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টির স্বাধীন রাজনৈতিক ইমেজ খুবই দুর্বল। দলীয় কোন্দলে বিভাজিত নেতৃত্ব এবং জনআস্থাও সীমিত। ভবিষ্যতে তারা যদি নিজেদের পুনর্গঠন করতে না পারে, তবে কেবল প্রধান দুটি দলের রাজনৈতিক দলের খেলার হাতিয়ার হিসেবেই থেকে যাবে।

এই প্রবন্ধে জাতীয় পার্টিকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কৌশল, নির্বাচনী তথ্য, আন্তর্জাতিক প্রভাব এবং জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি (জাপা) এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রাজনৈতিক দল। সামরিক শাসনের হাত ধরে জন্ম নেওয়া এবং স্বৈরশাসনের পথ বেয়ে রাজনীতিতে জায়গা করে নেওয়া এই দলটি গণতান্ত্রিক ধারায় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বারবার প্রধান দুটি রাজনৈতিক শক্তির ওপর ভর করে চলেছে।

কখনো আওয়ামী লীগ আবার কখনো বিএনপির কাছে হাত বাড়িয়েছে। কখনো ক্ষমতার শরিক, কখনো বিরোধী দলের আসনে বসে সরকারকে সমর্থন করে সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে।

আবার কখনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আড়ালে সমঝোতার রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই জাতীয় পার্টি নিজেকে এক ধরণের “কিংমেকার” বা ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে।

অতীতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে,এমন অভিযোগ রয়েছে। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিএনপিও জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করতে চাইছে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় উঠেছে।

১. জাতীয় পার্টির উদ্ভব ও রাজনৈতিক যাত্রা
জাতীয় পার্টির জন্ম হয় ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাত ধরে। সামরিক শাসনের বৈধতা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে দলটি প্রতিষ্ঠিত হলেও দ্রুতই সংসদীয় রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে।

১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাপা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন: বয়কট সত্ত্বেও জাপা আবার ক্ষমতায় আসে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর দলটি মারাত্মক সংকটে পড়ে। তবে পতনের পরও জাতীয় পার্টি টিকে থাকতে সক্ষম হয় মূলত স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের প্রভাব, গ্রামীণ ভোটব্যাংক ও প্রধান দলগুলোর রাজনৈতিক প্রয়োজনে।

২. আওয়ামী লীগের হাতে জাতীয় পার্টির ব্যবহার
২০০৮ সালের নির্বাচন ও মহাজোট ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করে। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মহাজোটের শরিক হয় এবং ২৭টি আসনে জয়লাভ করে। যদিও জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে অবস্থান নেয়, তবুও বাস্তবে তারা সরকারের নীতিকে সমর্থন করেছে।

৩. ২০১৪ সালের নির্বাচনে ফ্যাসিবাদের হাতিয়ার
২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত বর্জন করায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা শূন্য হয়ে পড়েছিল। তখন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে টিকিয়ে রাখে। যদিও এরশাদ একসময় নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত জাপা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। এতে নির্বাচন আংশিক বৈধতা লাভ করে।

৪. ২০১৮ সালের নির্বাচনে দ্বৈত ভূমিকা
২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আবারও আওয়ামী লীগের ছায়াতলে চলে আসে। একদিকে বিরোধী দলে, অন্যদিকে মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণ; এমন এক সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি হয়। ফলে জাপা কার্যত “সহযোগী বিরোধী দল” হয়ে ওঠে।

আওয়ামী লীগ বারবার জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করেছে বিরোধী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে, সংসদকে সক্রিয় দেখাতে এবং নির্বাচনের বৈধতা নিশ্চিত করতে।

৫. বিএনপির নতুন কৌশলে জাতীয় পার্টি
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিএনপির সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো একটি অংশগ্রহণমূলক ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করা। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টিকে টিকিয়ে রাখা এবং নিজেদের পাশে রাখা বিএনপির জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক।

বিএনপির যে কারণে জাতীয় পার্টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে,তা হলো-
ক. সংসদীয় ভারসাম্য রক্ষা: বিএনপি বুঝতে পারছে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও রাজনৈতিক ভারসাম্যের জন্য জাপাকে পাশে রাখা প্রয়োজন।
খ.আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা: বিদেশি কূটনীতিকরা চাইছে বহুদলীয় রাজনীতি টিকে থাকুক। বিএনপি তাই জাপাকে সক্রিয় রেখে নিজেদের শাসনকে অংশগ্রহণমূলক হিসেবে তুলে ধরছে।
গ. আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা: জাপাকে টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে বিএনপি আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সমঝোতার পথ রুদ্ধ করতে চাইছে। এতে করে বিএনপি নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় টিকে থাকা নিশ্চিত করতে চাচ্ছে।

নির্বাচনী পরিসংখ্যানে জাতীয় পার্টির আমলনামা
জাতীয় পার্টির ভোটশক্তি সীমিত হলেও ক্ষমতার ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯১ সালের নির্বাচন: জাপা পেয়েছিল ৩৫ আসন ।ভোটশেয়ার প্রায় ১২ শতাংশ। ঐ সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিযোগিতায় জাপা ছিল নির্ণায়ক।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাপার আসন কমে দাঁড়ায় ৩২টিতে। ২০০১ সালের নির্বাচনে মাত্র ১৪টি আসনে জয় পায়। তবে বিএনপি-জোটের শরিক হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটে থেকে ২৭ আসনে জয়লাভ করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩৪টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে। যদিও বাস্তবে তারা একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন করে গেছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জাপা পায় ২২টি আসন। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, জাপা কখনো এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো শক্তি নয়, তবে দুই প্রধান দলের রাজনীতিতে “কিংমেকার” হিসেবেই কার্যকর।

জাতীয় পার্টির আন্তর্জাতিক প্রভাব
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সবসময়ই বাংলাদেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন চায় নির্বাচনে বহু দল অংশগ্রহণ করুক। জাপাকে টিকিয়ে রাখা তাই বিএনপির জন্যও প্রয়োজনীয়। যেহেতু জাতীয় পার্টির কোন রাজনৈতিক আদর্শ নেই এবং রাজনৈতিক দর্শন বা পরিটিক্যাল ফিলোসফি নেই,সেহেতু জাতীয় পার্টির কোন আন্তর্জাতিক প্রভাবও নেই।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত কখনোই স্থিতিশীলতা চায় না। এজন্য ভারত সব সময় জাতীয় পর্টিকে দিয়ে আওয়ামী লীগের পাল্লা ভারি করতে চেয়েছে। চীন ও অন্যান্য শক্তির কাছে জাপা তেমন প্রভাবশালী নয়।

জাতীয় পার্টির সংকট ও সীমাবদ্ধতা
স্বাধীন পরিচয়ের অভাবে জনগণের কাছে জাপা মূলত সুযোগসন্ধানী দল হিসেবে পরিচিত। দলীয় বিভাজনে একাধিকবার দল ভাঙন ও নেতৃত্ব সংকটে পড়ে দুর্বল হয়ে গেছে। বার বার জনআস্থার ঘাটতি এবং সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের উত্তরাধিকার বহন করায় জনগণের কাছে তাদের অবস্থান ক্রমেই ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে। বড় দলের ছায়াতলে টিকে থাকায় জাপার রাজনীতি বরাবরই পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ
জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর।
প্রথমত: বিএনপির ক্ষমতায় টিকে থাকার স্থায়িত্ব।
দ্বিতীয়ত: আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল।
তৃতীয়ত: জাতীয় পার্টির নিজস্ব নেতৃত্বের পুনর্গঠন ও স্বতন্ত্র রাজনীতি গড়ে তোলার সক্ষমতা অর্জন করা।

জাতীয় পার্টির কাছে এখন তিনটি পথ খোলা রয়েছে।
এক. বিএনপির সহযোগী বিরোধী দল হয়ে টিকে থাকা।
দুই. আওয়ামী লীগের সাথে পুনরায় সমঝোতায় যাওয়া। অথবা
তিন. ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু থেকেই জাতীয় পার্টি এক অদ্ভুত দ্বৈত ভূমিকা পালন করে আসছে। তারা কখনো ক্ষমতার শরিক আবার কখনো বিরোধী দলের, আবার কখনো উভয় অবস্থানে থেকেও কার্যত প্রধান দুটি দলের কৌশলের অংশীদার।

আওয়ামী লীগ যেমন জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করে নিজেদের শাসনকে বৈধতা দিয়েছে, বিএনপিও এখন জাতীয় পার্টিকে টিকিয়ে রেখে নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত দিতে চাইছে।

তবে জাতীয় পার্টি যদি স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে না পারে, তবে ভবিষ্যতেও তারা কেবল প্রধান দুটি দলের রাজনৈতিক খেলার অংশ হিসেবেই থেকে যাবে। এভাবে এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

………………………………..
এফ শাহজাহান
ক্রাইসিস অ্যনালাইসিস
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
………………………………..

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ