৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

তারল্য সংকটে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আমানত নিয়ে বিড়ম্বনা-শঙ্কায় গ্রাহকরা

spot_img

চরম তারল্য সংকটে ভুগছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। মূলধনের ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি আর তারল্য সংকটে পদ্ধতিগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংক। আমানতের টাকা উত্তোলনে বেগ পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। এ যেন এক চরম বিড়ম্বনা! টাকা দিতে না পারায় হুমকি ধমকি মুখে পড়ছেন কর্মকর্তারা। তারল্য সংকটে ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার শঙ্কাও করছেন অনেক গ্রাহক। এদিকে কর্মকর্তারা দুশছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
ব্যাপক তারল্য সংকটে পড়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় গিয়ে মাসের পর মাস ঘুরেও টাকা পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। প্রতিষ্ঠানটির মতিঝিল প্রিন্সিপাল শাখায় এক মাসে তিনবার এসেও টাকা পাননি ইতালী প্রবাসী আফসার উদ্দিন নামের একজন গ্রাহক। এমনকি ব্যাংকটির এ শাখার ম্যানেজারকেও খুজে পাচ্ছেন না এই গ্রাহক। গতকাল রোববার আইসিবি ইসলামী ব্যাংক মতঝিল প্রিন্সিপাল শাখা ঘুরে গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়।

ইতালী প্রবাসী আফসার উদ্দিন বলেন, আমি ১৯৮৮ সালের পর থেকে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছি। এর আগে আমি কুয়েতে থাকতাম, বর্তমানে ইতালিতে থাকি। এই ব্যাংকে আমার একাউন্টে প্রায় ৮ লাখ টাকা রয়েছে। গত এক মাসের মধ্যে ৩ বার এসেছি, তবে এখনো টাকা পাইনি।
ব্যাংক থেকে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, টাকা পাবো এরকমটাই বলা হচ্ছে ব্যাংক থেকে। ব্যাংকে ঝামেলা চলতেছে বলেও কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন আমাকে। আবার প্রধান কার্যালয়েও যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। আমি যতবার এসেছি কখনো এই শাখার ম্যানেজারকে পাইনি। যখনই আসি তখনই বলা হয়, ম্যানেজার বাইরে চলে গেছে।

ব্যাপক তারল্য সংকটে পড়ে গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতমুক্ত তারল্য সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি টাকা চেয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ইতোমধ্যে ব্যাংকটির ৪২৫ কোটি টাকা দেনা রয়েছে। এর ফলে আবেদনের দুই সপ্তাহ পরে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে গড়ে ওঠে শরিয়াভিত্তিক আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটি লোকসানে আছে এবং ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকটির এক হাজার ৮২৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে ৭৯০ কোটি চার লাখ টাকা বিতরণ করা ঋণের (বিনিয়োগ) ৮৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূতকরণের তালিকায় রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, কারণ তারল্য সংকটে ধুঁকছে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি।

ফনিক্স ফাইন্যান্স: লোকসান কমাতে এখন কর্মী ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিয়েছে ফনিক্স ফাইন্যান্স। যারা চাকরি ছাড়ার মৌখিক নির্দেশ পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে একজন বলেন, এই বয়সে আমরা কোথায় যাব? কী করব? ছেলেমেয়েদের কী খাওয়াব? নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আস্থা হারানো একটি কম্পানির নাম ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৫৮ শতাংশই খেলাপি।
ফনিক্স ফাইন্যান্সের কম্পানি সচিব (চলতি দায়িত্ব) সাব্বিরুল হক চৌধুরী বলেন, আমানতকারীদের টাকা ফেরত না দিতে পারার বিষয়টা সত্য। প্রতিদিন অনেক গ্রাহক আসেন, যাঁদের টাকা আমরা ফেরত দিতে পারছি না। যখনই কোনো টাকা আদায় হচ্ছে, গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করছি।
আর্থিক খাত: বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ৩৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকই এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে। এর মধ্যে সংকটে আছে অন্তত ১০টি। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বারবার।

২০২০ সালের জুনভিত্তিক বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ স্ট্রেস টেস্টিং রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র চারটির আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো ছিল। বাকি ২৯টির অবস্থা ছিল নাজুক। ক্যাটাগরি অনুযায়ী ওই সময় ১৮টি প্রতিষ্ঠান ছিল ইয়োলো এবং ১১টি প্রতিষ্ঠান ছিল রেড জোনে। এর পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক আর স্ট্রেস টেস্ট রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ১৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা মোট ঋণের ৯০ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।

যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি সেগুলো হলো- পিপলস লিজিং ৯৯.০২ শতাংশ, বিআইএফসি ৯৬.৮৫ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৯৪.৭৬ শতাংশ, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ৯৪.৪১ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্স ৯২.৩৭ শতাংশ, এফএএস ফাইন্যান্স ৮৯.৫৬ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ৮৯.৪১ শতাংশ, আভিভা ফাইন্যান্স ৭১.৭২ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিং ৬৬.৭৪ শতাংশ, সিভিসি ফাইন্যান্স ৫৯.৩৯ শতাংশ, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ৫৯.১৭ শতাংশ, আইআইডিএফসি ৫৮.৬৪ শতাংশ, হজ্জ ফাইন্যান্স ৫৭.৭৯ শতাংশ, ফনিক্স ফাইন্যান্স ৫৭.৭৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ৫৬.৮৬ শতাংশ, বে লিজিং ৫২.৮২ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্স ৫০.৮২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টির খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশের ওপরে। সবগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা হলেও এই ১৭টি প্রতিষ্ঠানের সামষ্টিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও এফএএস ফাইন্যান্সের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বলেন, অন্যান্য খাতের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এর প্রধান কারণ ব্যাংক যে ব্যবসা করে তার বাইরে বিশেষ কোনো কাজ করে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংকে যারা ঋণ পায় না তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আসে। এখান থেকে ঋণ নেয়। একটা সময় খেলাপি হয়ে পড়ে। কিন্তু এদের মার্চেন্ট ব্যাংক, সাবসিডিয়ারি ও পুঁজিবাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়নীতির কারণে গত কয়েক বছর ব্যাংক খাতে লাগামহীন খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর ফলে সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায়। ছাড়ের কারণে অনেকে ভাবছে ঋণের টাকা না দিলেও চলবে। তাই যাদের অবস্থা ভালো তারাও টাকা ফেরত দিচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভালো গ্রাহক। যারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদের বেছে বেছে এ সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তবে এভাবে ঢালাওভাবে ছাড় দেওয়া ব্যাংক খাতের জন্য খুবই খারাপ চর্চা। এর ফলে ভালো গ্রাহকরাও দেখা যাবে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ