৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বগুড়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট; দুই যুগে সাতজনের মৃত্যু

spot_img

মাসুম হোসেন:

‘কেউ আসে না হামাকেরে খোঁজ লিতে। গায়ে জ্বালা-পোড়া করে। ওষুধ কিনার ট্যকা নাই। পানি কিনে খাই। সবাই খালি অ্যাসে আশা দেয়। পরে তাকেরেক আর দেখি না। হামরাও কিছু পাইনা।’

ভীষণ অভিমানে কথাগুলো বললেন এক বৃদ্ধা। নাম তার রাশেদা বেগম। তিনি আর্সেনিকে আক্রান্ত। তবে তিনিই একা নন, ওই গ্রামের ঘরে ঘরে রয়েছেন আর্সেনিকে আক্রান্ত মানুষ। শুধু তা-ই নয়, এক যুগেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে গ্রামটির সাতজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আর্সেনিক। এরপরেও অবহেলিত তারা।

এমন চিত্র বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের দক্ষিণ নগর আমরুল গ্রামের হুদার মোড়ের। সেখানে প্রায় ২৫ পরিবারের বসবাস। এরমধ্যে অন্তত ৪৫জন মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত। বছরের পর বছর ধরে বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন তারা। একই সঙ্গে আর্সেনিকজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণায় ভুগছেন নগর আমরুল গ্রামের বাসিন্দারা।

নগর আমরুল গ্রাম ছাড়াও আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে ইউনিয়নটির আরও ১২ গ্রাম। এরমধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ নগর আমরুল।

আর্সেনিক ঝুঁকিতে থাকা অন্য গ্রামগুলো হলো- নারচী, বড়নগর, শৈলধুকড়ী, রাজারামপুর, পলিপলাশ, রামপুর রাধানগর, গোবিন্দপুর, ক্ষুদ্র ফুলকোট, যাদবপুর, মাড়িয়া ও বৃষ্ণপুর। এসব গ্রামের অধিকাংশ স্থানে নলকূপের পানিতে রয়েছে আর্সেনিক।

নগর আমরুলের হুদার মোড়ের বাসিন্দা ৫০ বছরের মহিনূর বেগম ও তার স্বামী আব্দুল করিম ২২ বছর ধরে আর্সেনিকে আক্রান্ত।

কথা হয় মহিনূর বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, গ্রামের অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। চিকিৎসা করার টাকা নেই তাদের কাছে। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ বছর ধরে যন্ত্রণায় ভুগছেন তারা। তাদেরকে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেননি।

আর্সেনিকে আক্রান্ত একই গ্রামের ৩৬ বছরের তামান্না বেগম ও ৬৫ বছর বয়সী মরিয়ম বেগম জানান, গ্রামের অধিকাংশ ঘরেই দুবেলা-মুঠো খাওয়ার মত চাল-ডাল থাকে না। অনেকের শরীর ঘা হয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতস্থানগুলোতে চুলকায়। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নেন তারা।

তারা আরও জানান, নগর আমরুল গ্রামে তিনটি গভীর নলকূপ (সাব-মারসিবল পাম্প) বসানো আছে। এতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ হলেও তা সবার জন্য যথেষ্ট নয়।

নগর আমরুল গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। তার ভাই শফিকুল ও বোন শহিদা বেগম আর্সেনিকে আক্রান্ত।

সাইফুল বলেন, ‘দীর্ঘ বছর ধরে গ্রামে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির সংকট থাকলেও তা পূরণ করা হয়নি। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে গ্রামের মানুষেরা অনেক কষ্ট পাচ্ছেন। চিকিৎসা করার মত টাকাও থাকে না তাদের কাছে।’

সাইফুল ইসলাম ও তার স্ত্রী রুমি বেগমসহ ওই গ্রামের অন্তত ১৫জন বাসিন্দা জানান, চাহিদা অনুযায়ী গ্রামে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নেই। গ্রামে সাব-মারসিবল পাম্প থাকলেও পানি কিনে পান করার মতই। সাব-মারসিবল পাম্পের বিদ্যুৎ বিল গ্রামের সব ঘর থেকে টাকা তুলে পরিশোধ করা হয়। অনেক মাসে কেউ কেউ বিদ্যুৎ বিলের টাকা দিতে পারেন না। তাদের বিল গ্রামের অন্যরা দিয়ে দেন।

আমরুল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান অটল বলেন, ‘নগর আমরুল গ্রামে প্রায় ৭০০ পরিবার রয়েছে। তিনটি সাব-মারসিবল পাম্পের মাধ্যমে ১০০ পরিবার বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন। আর বাকিরা রয়েছেন আর্সেনিক ঝুঁকিতেই। তবে গ্রামটির মধ্যে হুদার মোড়ে ঝুঁকি বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমরুল ইউনিয়নে ৪০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে ১০টি সাব-মারসিবল পাম্প বসানো হয়। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে সাব-মারসিবল পাম্পগুলো বসানো হয়। ফলে আর্সেনিক ঝুঁকিতে থাকা ইউনিয়নের চার হাজার পরিবারের মধ্যে ৪০০ পরিবারকে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বাকিরা ঝুঁকিতেই থেকে যায়।’

দুই যুগেরও বেশি সময় আগে নগর আমরুল গ্রামের হুদার মোড় থেকেই আর্সেনিক দূষণের সূত্রপাত ঘটে বলে জানান আসাদুজ্জামান অটল।

আর্সেনিকে আক্রান্ত সাতজনের মৃত্যু

নগর আমরুল গ্রামের হুদার মোড়ে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে দুই যুগের ব্যবধানে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্য একই পরিবারের রয়েছেন পাঁচজন।

মৃতরা হলেন- আব্দুল কুদ্দুস ফকিরসহ তার প্রথম স্ত্রী জহুরা বেগম ও দ্বিতীয় স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন, আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে আব্দুর রশিদ ও রশিদের স্ত্রী কামরুন্নাহার।

মৃত অন্যরা হলেন- আব্দুল জলিল ও আফসার মোল্লা।

দুই যুগেরও বেশি সময় আগে প্রথম মারা যান জহুরা বেগম। ওই সময় গ্রামটির টিউবয়েলগুলোতে আর্সেনিকের প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বিগত এক যুগের ব্যবধানে মৃত্যু হয় বাকি ছয়জনের।

জানতে চাইলে বগুড়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. সাজ্জাদ-উল-হক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে শরীরে নানা ধরণের চর্ম রোগের সৃষ্টি হয়। প্রথমে শরীরে ঘা হবে, পরে ক্ষত সৃষ্টি হয়। যা আর কোনোদিন ঠিক হবে না। পরবর্তীতে হাত-পায়ের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। এছাড়াও ফুসফুসের ক্ষতিসহ লিভার সিরোসিস ও কিডনির সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর সর্বশেষ পরণতি মৃত্যু।’

কথা হয় কানাডার পানি সম্পদ প্রকৌশলী (ম্যাট্রিক্স স্যুলুশন) সাবরিনা রশিদ সেওঁতির সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘আর্সেনিক মূলত মাটির নিচের একটি উপাদান। এই খনিজ পদার্থ যখন ভূগর্ভের পানির স্তরের সংস্পর্শে যায়, তখন আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যায়। কোনো টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেলে সেখান থেকে পানি পান করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে।’

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের বগুড়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘গ্রামবাসীর আবেদন পেলে প্রয়োজন অনুযায়ী সাব-মারসিবল পাম্প বসানো হবে। এছাড়া আমাদের পরিকল্পনা আছে নতুন প্রকল্প পেলে ওই ইউনিয়নে পযাপ্ত বিশুদ্ধ পানির জন্য আরও সাব-মারসিবল পাম্পের বরাদ্দ দেওয়া হবে।’

এদিকে গ্রামবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘ বছরেও সংশ্লিষ্ট সরকারি কোনো দফতর থেকে তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া হয়নি।
আর্সেনিকজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন তারা।

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ