
রাজধানীর নামি একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তানিয়া (ছদ্ম নাম)। রোল নম্বরের ক্রমিক অনুযায়ী প্রথম ১০ জনের মধ্যে তার অবস্থান। ক্লাসে অংশ নিতে মর্নিং শিফটের শিডিউল অনুযায়ী প্রতিদিন সকাল ৭টার মধ্যেই স্কুলে পৌঁছাতে হয় তাকে। এজন্য অন্তত আধা ঘন্টা আগেই বাসা থেকে বের হতে হয়। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নাস্তাটা ঠিক মতো করা হয় না তার। এ অবস্থায় স্কুলের সাধারণ সমাবেশ শেষে কখনও লিফটে আবার কখনও সিঁড়ি বেয়ে ৮ তলায় উঠতে হয় তাকে। স্কুলে টিফিনের সুযোগ পেলে সঙ্গে আনা হালকা কিছু খাবার খেয়ে নেয়, আর খাবার না থাকলে এমনিতেই সময় পার হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ চার ঘণ্টার বেশি সময় ক্লাসে কাটানোর পর ১১টা ২৫ মিনিটে স্কুল ছুটি হলেই আবার দৌড়াতে হয় পাশেই একটি কোচিং সেন্টারের জায়গা ধরতে। সেখানে আবার শুরু হয় ‘দ্বিতীয় স্কুল’। একটানা প্রায় তিনঘণ্টা কোচিংয়ের ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে দেরিতে দুপুরের খাবার খায় সে। বিকালে কিছু সময় রেস্ট নিয়ে ফের সন্ধ্যার আগে ও পরে প্রাইভেট ব্যাচে পড়ায় ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। এভাবে অন্তত রাত ১০টা পর্যন্ত একের পর পড়ালেখায় ব্যস্ত সময় পার করেও পরদিন ক্লাসের জন্য প্রস্তুতিমূলক পড়ালেখায় আরও দুই ঘণ্টা কেটে যায়। একফাঁকে রাতের খাবার খেয়ে রাত ১২টার পর ঘুমের রাজ্যে গিয়ে দিনের কর্মসূচি শেষ হয়।
তবে দুঃখের খবর হলো- বেশ কিছুদিন ধরে আর তানিয়ার স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। কারণ জন্ডিসের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসাধীন সে। শুধু তানিয়াই নয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার আরও কয়েকজন বন্ধু নানা অসুখে আক্রান্ত হয়ে ঠিকমতো ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছে না। একই অবস্থা বিভিন্ন ক্লাসের বহু শিক্ষার্থীর।
অভিভাবকরা জানান, লেখাপড়ার জন্য এখন তাদের সন্তানরা অনেকটা নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় স্কুলের পাশাপাশি কোচিং ও প্রাইভেটে কাটিয়ে দেয়। এতে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে তারা। আর তাদের আনা-নেওয়া বা তদারকি করতে গিয়ে অভিভাবকদেরও চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। স্কুলের পর আবার কোচিং-প্রাইভেটে পড়ার প্রয়োজনীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন অভিভাবক জানান, ক্লাসে ঠিকমতো পড়ালেখা হয় না। শিক্ষকরা অনেকটা দায়সারাভাবে ক্লাসের সময় পার করেন। শিক্ষার্থীদের কিছু পড়া বা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েই যেন তাদের দায় শেষ। তারা ঠিকমতো দিকনির্দেশনা না দেওয়ায় কোচিং-প্রাইভেট টিচারদের ওপর ভরসা করতে হয়। এতেও না হলে গুগল-ইউটিউব বা অনলাইনের সাহায্য নিতে হয়। এতে পাঠ্যবই বা কারিকুলাম অনুযায়ী প্রকৃত শিক্ষা বা নির্দেশনা না পেয়ে যে যার মতো করে পড়ালেখা করছে শিক্ষার্থীরা।
অবশ্য ক্লাস টিচারদের এ অবস্থার কারণ সম্পর্কে কয়েকজন অভিভাবক জানান, স্কুলের শিক্ষকরাই আবার বাইরে প্রাইভেট ব্যাচ পড়ান। সেখানে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। এসব ব্যাচে পড়ার কারণে শিক্ষকদের বিশেষ সুবিধা পায় শিক্ষার্থীরা। আর যারা প্রাইভেট না পড়ে তারা কিছুটা বিপাকে পড়ে। যদিও স্কুল শেষে কোচিং-প্রাইভেটে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও প্রকৃত মেধার বিকাশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
শ্রেণি শিক্ষকদের অবহেলা আর কোচিং-প্রাইভেট চিত্র ফুটে উঠেছে গণসাক্ষরতা অভিযানের ‘এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট-২০২৩-এ’। ওই রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী মহামারির পরে তাদের নতুন শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। কিন্তু অর্ধেকের কাছাকাছি তাদের পাঠ বোঝার ক্ষেত্রে অসুবিধার কথা জানিয়েছে। একটি ক্ষুদ্র অংশ বলেছে, বোঝার ক্ষেত্রে তাদের বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা সাধারণত ক্লাসে পাঠদান বা তাদের নিজস্ব দক্ষতা সম্পর্কে নেতিবাচক মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাঠ অনুসরণে অসুবিধার কথা স্বীকার করেছে, তা উদ্বেগের বিষয়। শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠদানের সময় বৃদ্ধি ও বিস্তারিতভাবে পাঠ ব্যাখ্যার অনুরোধ জানিয়েছে।
সূত্রমতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় পর্যায়ে তিন চতুর্থাংশেরও বেশি শিক্ষার্থীর প্রাইভেট টিউটর/কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে, তা অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী উভয়েই উল্লেখ করেছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় ক্ষেত্রেই বাণিজ্যিক গাইডবইয়ের প্রতি প্রায় সবারই নির্ভরতা ছিল।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান জানান, নতুন কারিকুলামে কোচিং-প্রাইভেটের প্রয়োজন হবে না। ক্লাসেই সব সমাধান হওয়ার কথা। তবে রাজধানীর মতো তথাকথিত কিছু নামি স্কুলের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের এই কারিকুলাম সম্পর্কে ভয় দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, নামি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও অনেক মেধাবী। তাদের তো এত কোচিং-প্রাইভেট লাগার কথা নয়। তারপরও বাস্তবে কোচিং-প্রাইভেট ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। আসলে এসব শিক্ষক আগেও ক্লাসে পড়াতেন না, এখনও পড়াচ্ছেন না। সেজন্যই এ অবস্থা দেখা দিচ্ছে।
জানা গেছে, শ্রেণি শিক্ষকদের কোচিং-প্রাইভেট নিয়ন্ত্রণে ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ নামে একটি নীতিমালা করে সরকার। এতে বলা হয়-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম চলাকালীন শ্রেণি সময়ের মধ্যে কোন শিক্ষক কোচিং করাতে পারবেন না। তবে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বা পরে শুধুমাত্র অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধান অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। আরও বেশ কিছু নিয়মনীতি উল্লেখ করা হয় এতে। তবে বাস্তবে এই নীতিমালার কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন-২০২০ এ একই ধরনের বিধান উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিভাবকরা জানান, স্কুলের ক্লাসে ঠিকমতো পড়ালে শিক্ষার্থীদের এত হয়রানি যেমন হতো না, তেমনি অভিভাবকদের বাড়তি খরচের বোঝাও চাপত না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং সংশ্লিষ্টদের কঠোর মনিটরিং কামনা করেন তারা।