৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

আত্মশুদ্ধির মলয় বাতাস, রমজানের আগমনে মুমিনের হৃদয়ে নবজাগরণ

spot_img

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

রমজান এক পবিত্র ধ্বনি, যা আসমানের নীলিমায় প্রতিধ্বনিত হয়, মুমিনের অন্তরে জাগিয়ে তোলে আত্মশুদ্ধির তৃষ্ণা। বছরের অন্যান্য সময় যখন জীবনের ব্যস্ততায় আত্মা প্রায়শই অবহেলিত হয়ে পড়ে, রমজান তখন আসে আধ্যাত্মিকতার এক নবতর প্রভাত হয়ে। এ মাসে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার রহমতের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়, যা পাপের মরচে ধরা হৃদয়কে শুদ্ধতার নূরে সিক্ত করে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:
“হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো।”(সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)

রমজান শুধু সিয়াম সাধনার মাস নয়, এটি এক মহাসমুদ্র, যেখানে মুমিনেরা তাকওয়ার মুক্তো আহরণ করে। এ মাসের প্রতিটি দিন যেন একটি নূরানী প্রদীপ, প্রতিটি রাত যেন আত্মার প্রশান্তির নীড়।

প্রথমেই একজন মুমিন নিজেকে প্রস্তুত করেন নিয়ত পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে। তিনি জানেন, প্রতিটি আমলের মূল হলো নিয়ত। তার অন্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টির তৃষ্ণা, তার চোখে আখিরাতের স্বপ্ন। তিনি জীবনের পুরনো পাপের গ্লানি মুছে ফেলে আল্লাহর দরবারে তওবার অশ্রু ঝরান।

রাসূলুল্লাহ সা.বলেন:
“যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্বেকার সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।”(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৮)

রমজানের প্রস্তুতি কেবল বাহ্যিক নয়, এটি আত্মার অভ্যন্তরে। তিনি তার দৈনন্দিন জীবনকে নতুনভাবে সাজিয়ে নেন। প্রতিটি নামাজ যেন হয় প্রাণবন্ত, প্রতিটি সিজদায় যেন হৃদয় আল্লাহর প্রেমে বিগলিত হয়। সাহরির সময় ঘুম থেকে জাগা শুধু পেট ভরানোর জন্য নয়, বরং তাহাজ্জুদের নীরব প্রহরে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া।

দিনের বেলায় রোজা রাখার অর্থ কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে সংযত করা নয়; বরং প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে পাপ থেকে বিরত রাখা। চোখকে হারাম দৃশ্য থেকে, কানকে অশ্লীল কথাবার্তা থেকে, জিহ্বাকে মিথ্যা, গীবত ও অনর্থক বাক্য থেকে দূরে রাখা। একজন মুমিন জানেন, প্রকৃত রোজাদার সেই, যার অন্তরও সংযমের আবরণে আবৃত থাকে।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
“যদি কেউ রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং খারাপ কাজ করা থেকে বিরত না থাকে, তবে তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই।”(সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯০৩)

রমজান আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি দান-সাদকারও এক মহান মাস।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:

“যারা নিজেদের সম্পদ রাতদিন, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।”(সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৪)

তিনি তার হাতকে উদার করেন, সমাজের গরীব-দুঃখীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। ইফতারের সময় কেবল নিজের পেটের তৃপ্তির জন্য নয়, বরং অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে তিনি সদা প্রস্তুত থাকেন। প্রতিটি সদকা যেন তার অন্তরের মলিনতা ধুয়ে দেয়, তাকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে আসে।

রমজানের রাতগুলো তার কাছে একেকটি সোনালি সুযোগ। তারাবির নামাজ শেষে তিনি কুরআনের সুরে ডুবে যান, তেলাওয়াতের প্রতিটি শব্দ যেন তার অন্তরে আলো জ্বেলে দেয়। কুরআনের অর্থ বোঝার চেষ্টা করেন, যেন তার জীবনকে সেই আলোর পথে পরিচালিত করতে পারেন।

রমজানের শেষ দশ দিন—এগুলো যেন একেকটি মুক্তো। লাইলাতুল কদরের সন্ধানে তিনি আরও বেশি ইবাদতে মনোযোগী হন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“লাইলাতুল কদর হলো এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।”(সূরা আল-কদর, আয়াত: ৩)

এ মাসে তিনি শুধু নিজেই ইবাদতে মশগুল থাকেন না, বরং পরিবারের সদস্যদেরও আল্লাহর ইবাদতে উৎসাহ দেন। ছোটদের রোজার গুরুত্ব বোঝান, তাদের কুরআন শেখাতে বসেন, তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রেমের বীজ বপন করেন।

রমজান তার কাছে এক আত্মার পরিশুদ্ধির প্রকৃত শিক্ষা। এ মাস তাকে শেখায় কিভাবে দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে আখিরাতের পথে পা বাড়াতে হয়। সে যেন বছরের বাকি সময়েও রমজানের এই প্রশান্তি ধরে রাখতে পারে—এমনই তার প্রার্থনা।

পরিশেষে, রমজান মুমিনের জীবনে এক মহামূল্যবান সুযোগ। এ মাস তাকে আল্লাহর প্রেমে উদ্ভাসিত করে, তাকওয়ার চূড়ায় পৌঁছে দেয়। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে এই রমজানকে জীবনের শ্রেষ্ঠ রমজান হিসেবে কাটানোর তাওফিক দেন, আমাদের গুনাহ মাফ করেন এবং জান্নাতের পথে আমাদেরকে পরিচালিত করেন। আমীন!

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ