৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

একদিনের সফর দুই শতাব্দীর গল্প

spot_img

দেবযানী মিস্ত্রী ঐশ্বী

“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায় ” একটা গান, একটা পঙক্তি, যেন হঠাৎ করে সময়কে পিছিয়ে দেয়। যেখানে স্মৃতি, ইতিহাস আর অনুভূতিরা হাত ধরে হেঁটে আসে আজকের দিনেও। আজও সেই পুরানো গানের লাইনটা হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যখন আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম খুলনার দুইশত বছরের পুরানো জরাজীর্ণ চার্লি নীলকুঠির দুয়ারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদিনের ক্লাস মানেই নিয়মিত পাঠ আর সময় ধরে বেঁধে দেওয়া কিছু কাঠামো। কিন্তু কোন কোন দিন সেই কাঠামো ভেঙে আসে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত। যেখানে থাকে নতুন কিছু শেখার আনন্দ। আর আমাদের ঝুলিতে যুক্ত হয় কিছু মিশ্র স্মৃতি ও অনুভূতি।

আজ ছিল ঠিক তেমনি একটা দিন। ক্লাসে সবে বসেছি। স্যার এলেন, অনেক আলোচনা শেষে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আপনারা কেউ চার্লি নীলকুঠি সম্পর্কে জানেন? সবাই স্যারের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম। আর ভাবতে লাগলাম কী সেই বস্তু! অবশেষে স্যার জানালেন এটি খুলনার দুইশত বছরের পুরনো একটি বাড়ি। আজকে আর ক্লাস নয়। আজ আমরা যাবো ইতিহাস ছুঁয়ে দেখতে। এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করতে পারলাম না যে, আমরা সত্যি সত্যি ইতিহাসের মুখোমুখি হতে চলেছি।

গন্তব্য আমাদের খুলনার সেই বিখ্যাত চার্লি নীলকুঠি যার বয়স দুইশত বছরের বেশি। যা কেবল একটি প্রাচীন ভবন নয়, এটি একসময়ের চরম নিপীড়ন, বঞ্চনা এবং হাজারো কৃষকের অশ্রুগাথা ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী।

রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম এই শহর কত বদলে গেছে। কিন্তু চার্লিকুঠির দিকে পা বাড়াতেই মনে হল সময় যেন পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শত বছর পেছনে।

পুরানো ইট ও কাঠের গায়ে লেগে থাকা শ্যাওলা, নীরব প্রাচীন দরজায় ঝুলে থাকা তালা, আর ইতিহাসে ঢাকা দেয়ালগুলো সব মিলে কুঠিটি যেন এক জীবন্ত চরিত্র।

দূর থেকে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল যেন দেয়ালগুলো কথা বলছে। এই বাড়ির মেঝেতে হয়তো একদিন কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছিল কোন এক কৃষক। হাত জোড় করে মিনতি করছিল তাকে আর চাবুক না মারতে। আর এই বারান্দা দিয়েই হয়তো হেঁটে যেত সাহেবরা ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে। তাদের অট্টহাসির ফাঁকে মিলিয়ে যেত গ্রামের গরিব মানুষের বুকফাটা কান্না।

সবাই কৌতুহল নিয়ে দেখছিল বাড়িটি, আবার কেউ ক্যামেরাবন্দি করছিল ইতিহাস। আর আমি নীরবে দাঁড়িয়ে অনুভব করছিলাম চার পাশের আবহ। মনে মনে ভাবছিলাম একসময় কতইনা ঝকঝকে, দাপুটে ছিল এই বাড়িটি। ক্ষমতা, টাকা, সৌন্দর্য কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়, এই বাড়িটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আজ আকাশটাও খানিকটা নীল। অথচ নীলকুঠির এই নীলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে শত শত বছরের অন্ধকার ও ভয়ানক ইতিহাস। যা ভাবলে আজও কেঁপে ওঠে বাঙালির হৃদয়। মনে করিয়ে দেয় সাদা চামড়ার পেছনের কালোর মলিন অবয়ব টাকে।

এক হঠাৎ সিদ্ধান্ত সবাইকে টেনে নিয়ে গেল দুই শতবর্ষের পুরনো সেই ইতিহাসের দোরগোড়ায়। আজ বুঝলাম ইতিহাস কেবল বইয়ের পাতায় নয়, সময়ের সাথে সাথে দেয়ালেও লেখা থাকে। বেঁচে থাকে নিঃশব্দ ভবনের গা ঘেঁষে। আর ঠিক একদিন হঠাৎ আমাদের ডেকে নিয়ে যায় তার নিঃশব্দতার সাক্ষী হতে।

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ