
২০২৪-এর জুলাই মাসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ওপর ভারত সমর্থিত হাসিনার খুনে বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে; বাংলাদেশের গণমানুষ তখন রাজপথে নেমে আসে। ডান-বাম বিভাজন মুছে দিয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হবার কারণেই ভারতের ছায়া উপনিবেশ মুক্ত বাংলাদেশের নতুন যাত্রা সম্ভব হয়েছে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট।
সাড়ে পনেরো বছরের ভারতীয় নির্যাতনের ছিট মহল হয়ে ওঠা বাংলাদেশ অনেক দিন পর মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়। এই মুক্তির আনন্দ উদযাপনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে কথিত তৌহিদি জনতা। তারা ঠিক যেন পতিত মোদি জনতার মতো আচরণ করতে থাকে। মোদি জনতা যেমন দাড়ি টুপিওয়ালা মানুষ দেখলেই তাকে হত্যাযোগ্য মনে করতো; তৌহিদি জনতা ঠিক তেমনি উদারপন্থার মানুষ দেখলেই তাদের শাতিমে রসুল নাম দিয়ে হত্যাযোগ্য ঘোষণা দেয়।
তুরস্ক থেকে ইরাক-আফঘানিস্তান হয়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামের কোমল ধারা একে জনপ্রিয় করে তুলেছিলো। এই নরম ইসলামের প্রচারকদের মাজারগুলো ছড়িয়ে আছে এশিয়ার বিরাট অঞ্চল জুড়ে। ৫ অগাস্টের পর কথিত তৌহিদি জনতা নির্বিচারে মাজার ভেঙ্গে কট্টর ইসলামের ফ্যাসিজম তৈরি করে। ঠিক যেন মোদি জনতার ফ্যসিজমের মতো; যারা ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছিলো, অসংখ্য মসজিদ ভেঙ্গে অবশেষে আওরঙ্গজেবের সমাধি ভাঙ্গতে উদ্যত। তৌহিদি জনতা নারী পোশাক নিয়ে সামাজিক পুলিশি শুরু করে। ঠিক যেরকম আওয়ামী লীগের মোদি জনতা হিজাব পরা নারীর হিজাব খুলে ফেলার উদ্যোগ নিতো।
কট্টর হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় মিডিয়া ৫ অগাস্ট থেকে উপনিবেশ হারানোর বেদনায়, “হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলেই বাংলাদেশ কট্টর ইসলামপন্থী হয়ে যায়” বলে ন্যারেটিভ প্রচার করেছিলো। অথচ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারতের নেতৃত্বের চেয়ে শতগুনে উদারপন্থী ড ইউনুসের নেতৃত্ব। শুধু তৌহিদি জনতা যেন মরিয়া ভারতীয় প্রোপাগান্ডা সত্য প্রমাণে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রীরা ও বাম ছাত্র সংগঠনেরা; তৌহিদি জনতার এই নৈরাজ্যের প্রতিবাদ করে। নারীর প্রতি সহিংসা প্রতিরোধে এই আন্দোলন নতুন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আন্দোলন। কারণ দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী যদি স্বাধীনভাবে চলাফেলা করতে না পারে; তাহলে ৫ অগাস্টের স্বাধীনতা অর্ধেক হয়ে যায়।
যে ডানপন্থী ছাত্ররা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো; তারা ঐ আন্দোলনের সহযোদ্ধা বাম ছাত্রছাত্রীদের “শাহবাগী” বলে তকমা দিয়ে সাইবার বুলি শুরু করে। একই কৃষিজীবী সমাজ থেকে উঠে আসা মানুষ ঢাকায় এসে কেরানিগিরি করলে শাহবাগী আর গ্রামে থেকে গিয়ে কৃষিকাজ করতে থাকলে শাপলা। কি আজগুবি বাইনারি। শেখ হাসিনার বিরিয়ানির হাড়ি দিয়ে তৈরি দুটি বিভাজনমূলক মঞ্চকে কেন্দ্র করে অলীক দ্বন্দ্ব হাসিনার ভুত হয়ে খেলাতে থাকে মনোজগতে। আওয়ামী লীগের ক্লার্কের ছেলে নক্সী পাঞ্জাবি পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হিন্দু জমিদার সেজে আর হেফাজতের মাদ্রাসা সুপারের ছেলে নবাবি বন্দোবস্তের মুসলমান জমিদার সেজে কি ফাঁপা শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার!
এইসব বালখিল্য বিভাজনের খেলায়; বামেরা ভুলে যায় কিভাবে মেনন ও ইনু হাসিনার ফ্যাসিজমের সম্মতি উতপাদক হয়েছিলো; ডানেরা ভুলে যায় কিভাবে শফি হুজুর ও বাবু নাগরী হাসিনার ফ্যাসিজমের সমর্থক হয়েছিলো।
সেইসব ভুল নেতৃত্বের শিক্ষা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাম ও ডান তারুণ্য হাসিনার ফ্যাসিজমের মূল উতপাটনে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করেছে বলেই ভারতের ছায়া উপনিবেশের জাল ছিন্ন করা গেছে। কিন্তু তাদেরকে বিভাজিত দেখলে ভারত আবার ধীরে ধীরে তার কর্মচারিদের দল আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে এগিয়ে আসবে এতো জানা কথা। ডানদের মনে রাখা উচিত জাতির সংকটের মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে বামদের দ্রোহযাত্রার কথা। বামদের মনে রাখা উচিত; আওয়ামী লীগ শেষ মুহূর্তে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে ইস্যু ঘুরানোর চেষ্টা করলে; বৃহত্তর স্বার্থে ডানেরা এর প্রতিবাদ না করে বরং যাত্রাবাড়িকে করে তুলেছিলো ফ্যাসিস্ট প্রতিরোধের লেনিনগ্রাদ।
একই সমাজের মানুষ আমরা। কেউ জিনস টি শার্ট পরে, কেউ পাজামা পাঞ্জাবি পরে, কেউ জিনস ও ফতুয়া পরে, কেউ হিজাব পরে। একেকজন সৃষ্টিকর্তাকে একেকভাবে পেতে চায়; একেকজনের আধ্যাত্মিকতা একেকরকম। কিন্তু মূল লক্ষ্য সত্য সুন্দর নৈতিকতার অনুসন্ধান। আর এটা মানুষের ফ্রিডম অফ চয়েস বা ইচ্ছার স্বাধীনতা।
পৃথিবীর যেসব দেশ কল্যাণরাষ্ট্র হতে পেরেছে; তারা দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করেছে। একে অপরের লাইফ স্টাইল, পোশাক নিয়ে কাইজ্জা করেনি। ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখুন। দেশের দারিদ্র্য ধূসর মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা না করে সারাক্ষণ কট্টর হিন্দুত্ববাদ নিয়ে রয়েছে। আর বর্তমানের সংকটকে ধামাচাপা দিতে তিনশো বছর আগের আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বিদ্বেষমূলক চলচ্চিত্র বানিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন জ্বালায়।
বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ঠেকাতে প্রথমেই ভারতের নরভোজি রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বর্জন করতে শিখতে হবে। সাম্প্রদায়িক কুঁচকুঁচানি, ডিভাইড এন্ড রুলের রাজনীতি, ফাঁপা শ্রেষ্ঠত্বের অহম দিনশেষে লুজারের নিয়তি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ঐক্যের রাজনীতি ও পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনই হচ্ছে বিজয়ীর রাজনীতি।