৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৩ই রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

নেতৃত্বের প্রশ্নে থমকে আছে বিএনপিবিরোধী জোট

spot_img

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠনের আলোচনা চলছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ এবং আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি) পার্টির। ইতোমধ্যে চারটি দলের একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে মূলত দুটি কারণে জোট গঠনের অগ্রগতি থমকে আছে।

সূত্রমতে, প্রথমত, জোটের নেতৃত্ব কে দেবেন সেটি ঠিক করা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কৌশল এবং আদর্শগত বিষয়গুলো নিয়েও দলগুলোর নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে।

যদিও চারটি দলের মধ্যে জামায়াতকেই বড় দল বলে মনে করা হয়। কিন্তু দলটির আমিরকে জোটের প্রধান নেতা করার প্রশ্নে অন্য তিনটি দলের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে। ওই তিনটি দলের নেতারা মনে করছেন, সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করা হলে রাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব আস্তে আস্তে কমে যাবে। পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত অন্য দলগুলো জামায়াতকে জড়িয়ে এসব দলকে ‘ট্যাগ’ দেওয়ারও সুযোগ পাবে বলে তারা মনে করেন।

যদিও নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার প্রশ্নে তিনটি দলই জোট গঠনে আগ্রহী। জামায়াতের পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের ‘সহযোগিতা’ করার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। তবে দলটির আমিরকে শীর্ষ নেতা মানতে তাদের কারও কারও আপত্তি রয়েছে। 

সম্প্রতি, ওই তিনটি দল ও জামায়াতের মধ্যে এক বৈঠকে সভাপতিত্ব কে করবেন তা নিয়ে সভায় উপস্থিত নেতাদের মতামত জানতে চান এক জামায়াত নেতা। এ সময় এবি পার্টির পক্ষ থেকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নাম প্রস্তাব করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে সবাই তা মেনে নেন। তবে ওই তিনটি দলের একাধিক নেতা  জানান, জামায়াত বিষয়টি ‘মেনে নিলেও মনে নেয়নি।’

সূত্র জানায়, প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার পর জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের সুবিধা-অসুবিধা এখন পর্যালোচনা চলছে তিন দলের মধ্যে। বিশেষ করে, বড় দল হওয়া সত্ত্বেও দলগতভাবে জামায়াতের নেতৃত্ব মানার লাভ-ক্ষতির বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছেন। কারণ তিনটি দলই তরুণ নেতৃত্বের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে তাদের নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এমন পরিস্থিতিতে, সুধী সমাজের কেউ কেউ তাদের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, শুধু জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করা হলে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি রাজনীতিতেও তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার  বলেন, ‘ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বা সমঝোতার প্রচেষ্টা চলছে। সেই আলোচনা এখনো চলমান। এখানে অন্য দলগুলোকে দেখা যেতে পারে। আরও কিছু সময় অতিবাহিত হলেও ঐক্যের বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া যাবে।’

উদারপন্থি দল ছাড়াও ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের সঙ্গে সম্ভাব্য জোট গঠন নিয়ে আলোচনা চলছে জামায়াতের। তবে উদারপন্থি ও ইসলামপন্থি দলগুলোর সবাই জামায়াতের কোনো নেতাকে শীর্ষ নেতা হিসেবে মানছেন না বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। কিন্তু এই দুই মেরুর বেশির ভাগ নেতা আবার একটি প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকার সম্পাদককে নেতা মানেন। তার নেতৃত্বে পৃথক একাধিক জোট করে বৃহত্তর ওই জোটের নাম ‘বাংলাদেশ জোট’ করার কথাও কেউ কেউ বলছেন।

২০২০ সালের ২ মে সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এই তিন মূলনীতির ভিত্তিতে গঠিত হয় এবি পার্টি। তবে দলটির প্রতিষ্ঠাতা মুজিবুর রহমান মঞ্জুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে জামায়াতের বিরোধের সূত্র ধরে প্রথমে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরে তিনি দল গঠনের উদ্যোগ নেন। দল গঠনের পর মঞ্জু বলেছিলেন, একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন।

কোটাবিরোধী আন্দোলন ও শেখ হাসিনার সরকার পতনের নেতৃত্বে থাকা তরুণ নেতাদের সমন্বয়ে এনসিপি গঠিত হয় চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি। এই দলের অনেককে ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতিতে জড়িত থাকার ট্যাগ দেওয়া হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দলটির অবস্থান এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে।

অন্যদিকে, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করে গণঅধিকার পরিষদ। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে দলটি এখনো কোনো বিতর্কিত বক্তব্য দেয়নি। ডান ও বামপন্থি দলের বাইরে এই তিনটি দলই উদারপন্থি দল হিসেবে পরিচিত।

তাই রাজনৈতিক অবস্থান তথা নীতিগত দিক থেকে এই তিনটি দলই কিছুটা উভয় সঙ্কটে পড়েছে। কারণ, ভোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশে তাদের হয় বিএনপি, নয়তো জামায়াতকে প্রয়োজন। অন্যদিকে উদারপন্থী অবস্থানও তারা হারাতে রাজি নয়।

সূত্র জানায়, এমন পরিস্থিতির কারণে সুধী সমাজের কেউ কেউ শুধু জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের পরিবর্তে উদারপন্থি বলে পরিচিত অন্য ছয়টি দলকে কাছে টানার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, মোট নয়টি উদারপন্থি দলের সমন্বয়ে জোট গঠিত হলে জামায়াতের ট্যাগ ঘুচে যাওয়ার পাশাপাশি একটি ভিন্ন রাজনৈতিক রূপ বা মেরুকরণ লাভ করবে। যেটির অবস্থান হবে ডান, বাম ও মধ্যপন্থি দলের ‘মিশ্রণে’ একটি জোট। প্রয়োজনে এসব দলের মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য একজনকে শীর্ষ নেতা করার কথাও কেউ কেউ ভাবছেন।

বিএনপি সবচেয়ে বড় দল হওয়া সত্ত্বেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে কৌশলগত কারণে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে গঠিত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

আমার বাংলাদেশ এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু  বলেন, ‘জোট গঠন নিয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। তবে নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় আসার জন্য আমাদের আলোচনা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি জোটও হয়, সেই জোটে জামায়াতে ইসলামী থাকবে না। জোটে আরও দল যোগ দেবে কি না তা সময়ই বলে দেবে।’ এনসিপির নাহিদ ইসলাম জোটের কান্ডারি হতে পারেন বলেও তিনি জানান।

বাম ও উদারপন্থি বলে পরিচিত ছয়টি দলের সমন্বয়ে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট গণতন্ত্র মঞ্চ গঠিত হয়েছে। এই মঞ্চের দলগুলো হলো, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য, আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি, জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলন, সাইফুল হকের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসনাত কাইয়ুমের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলন এবং শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুর নেতৃত্বাধীন ভাসানী জনশক্তি পার্টি।

জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের আলোচনা হয়েছে। কেউ কেউ আমাকে বলতে চেয়েছেন, আপনাকে নেতা মেনে আমরা একটা জোট করতে পারি কিনা। তবে আমি বলেছি, আগে তোমরা রাজি হও এরপর তোমাদের প্রস্তাব এলে ভেবে দেখব।’

সূত্রমতে, সুধী সমাজের পাশাপাশি এসব দলের নেতাদের একাংশের পরামর্শে ইতোমধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে সমস্যা এক্ষেত্রেও রয়েছে। কারণ ওই দলগুলোরও জামায়াতের নেতৃত্বে জোট গঠনে আগ্রহ কম। তা ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে বিএনপির সুসম্পর্ক রয়েছে। এদের দু-একজন নেতাকে নির্বাচনে বিএনপি ‘ছাড়’ দেবে বলেও আলোচনা রয়েছে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি  বলেন, ‘আমরা এখন সংস্কার বাস্তবায়ন এবং দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ নিরসনের চেষ্টা করছি। তবে জামায়াতকেন্দ্রিক বলয়ের সঙ্গে জোট করার প্রশ্নই ওঠে না।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাতিরপুলের একটি রেস্তোরাঁয় ৯টি দলের এক বৈঠকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির বিরোধ নিরসনের উপায় নিয়ে আলোচনা হয়। তবে বৈঠকে উপস্থিত দু-একজন নেতা ৯টি দলের ওই বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ ছিল বলে উল্লেখ করে খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, সম্ভাব্য জোটের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন  বলেন, ‘৯ দলের মধ্যে জোট গঠনের বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা চলছে। দলীয় ফোরামেও এ ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। তবে আলোচনা এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বলয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই এনসিপির। সে জন্য এই দুই দলের বাইরে পৃথক বলয় গড়ে তুলতে চাইছে এনসিপি।’

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান  বলেন, ‘নির্বাচনি জোট নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। আমাদের মধ্যে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি নিয়ে তৈরি হওয়া অনৈক্য নিরসনে আলোচনা চলছে। ঐকমত্য তৈরির বিষয়ে সবাই আগ্রহী। এ ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার ও বিচার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই বিএনপি ও জামায়াতসহ অন্য দলের সঙ্গেও আলোচনা হবে।’

জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন খষ বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে ৯ দলের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনার জন্য পৃথক টিম গঠন করা হয়েছে। ওই আলোচনায় কেউ কেউ জোট গঠন করতে পারে কিনা মতামত দিয়েছেন। সব দলই ইতিবাচকভাবে দেখছে। জোট গঠনের প্রাথমিক আলোচনা চলমান রয়েছে। যদি জোট হয় তাহলে যৌথ নেতৃত্ব থাকতে পারে।’

একাধিক জোট মিলে বৃহত্তর জোট হলে সেখানে জামায়াতে ইসলামীকে দেখা যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘জোটে জামায়াত থাকবে না। আদর্শিক ও ভোটের লড়াই সম্পূর্ণ আলাদা। ভোটের হিসাব-নিকাশ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জামায়াত নয়, উল্টো বিএনপির সঙ্গে আমাদের জোট হতে পারে। কারণ গণতন্ত্র মঞ্চ বিএনপির সঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে ছিল।’

সর্বাধিক জনপ্রিয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ